প্রান্তজন রিপোর্ট: নারীর প্রতি প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে মর্যাদা বৃদ্ধি ও আত্নোন্নয়নে নিরলস ভূমিকা রেখে চলেছেন নাটোরের অপরাজিতা মুসলিমা আক্তার। নারীর প্রতি ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নারীকেন্দ্রিক সামাজিক পশ্চাৎপদ ধারণাসমূহ থেকে উত্তরণে নারীকেই জেগে উঠে প্রতিবাদ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। একজন নারীর জন্য যেখান থেকে সামাজিক নিগ্রহের শুরু সেখান থেকেই তার মন-মনন-চিত্তের আমূল পরিবর্তনের তাগিদ মুসলিমার। মুসলিমা আক্তার নাটোর সদর উপজেলার বড়হরিশপুর ইউনিয়নের দত্তপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং দলটির অঙ্গ সংগঠন নাটোর সদর উপজেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে গত এক বছর যাবৎ সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। নিজ এলাকায় সকলের চেনা মুখ ও পরোপকারি হিসেবে পরিচিত তিনি। স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ২০১১,২০১৬ এবং ২০২১ সালে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তবে প্রতিবারেই অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি। ভোটে হারলেও এলাকার মানুষের মন জিতেছেন মুসলিমা। কেননা ভোটে হারার পরও তিনি মানুষের পাশে দাঁড়ানো বন্ধ করেননি। সমাজের অসহায় ও দুঃস্থ নারীদের পাশে ভরসা হয়ে দাড়িয়েছেন তিনি। তবে এই পথচলার শুরুটা সহজ ছিলো না মুসলিমার। তিনি যখন ৭ম শ্রেণির ছাত্রী তখন পরিবারের চাপের মুখে বিয়ে করতে হয় তাকে। বিয়ের পর তিনি উপলব্ধি করেন বাল্য বিয়ের কুফল। সংসার সামলে আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি মুসলিমার।সংসার চালাতে গিয়ে দেখেন বয়সে ছোট হওয়ায় তার শারীরিক ও মানসিক চাপ বেড়েছে। কঠিন এ পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে তিনি চিন্তা করেন একজন নারীকে বিয়ের আগে সুশিক্ষিত হওয়াটা অতীব জরুরি। এ লক্ষ্যে তিনি শুরু করেন সমাজ সচেতনতামূলক কার্যক্রম।নিজ এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজের বাস্তব জীবনের দৃষ্টান্ত টেনে নিরুৎসাহিত করতে শুরু করেন বাল্য বিবাহ ও যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে। স্বেচ্ছাসেবামূলক এ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে তিনি দেখেন নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে বাল্য বিবাহের মত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এছাড়া বাল্য বিবাহের শিকার অনেক নারী সংসার জীবনে নিদারুণ অর্থকষ্টে পতিত হয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন। এই করুণ অবস্থা তাকে ভাবিয়ে তোলে। ২০১৯ সাল থেকে মুসলিমা অপরাজিতা প্রকল্পের ইউনিয়ন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হন। প্রকল্পের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও সভা থেকে তার অর্জিত জ্ঞান-দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ান তিনি। তিনি ইউনিয়ন নেটওয়ার্কের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে তার নিজের সঞ্চিত অর্থ দ্বারা এলাকার বেশ কিছু নারীকে তাদের পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মুখ দেখান। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দত্তপাড়াসহ আশেপাশের বেশ কিছু এলাকায় অস্বচ্ছল নারীরা কালাইরুটি, শীতকালীন পিঠা ও ক্ষুদ্র ব্যবসা করে এখন উপার্জন করেন। অপরাজিতা প্রকল্পের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সফর, প্রশিক্ষণ, সভা, সেমিনার তাকে আরো যোগাযোগমুখী, দক্ষতা সম্পন্ন ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। মুসলিমা বলেন, উন্নয়ন কার্যক্রমসহ পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকরী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন আরও বেশী প্রয়োজন এবং অপরিহার্য । পাশাপাশি নারী যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় তাহলে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে সে অবদান রাখতে পারে। নারীর প্রতি নির্যাতন-বৈষম্য কমিয়ে আনতে নারীরা ইতোমধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছেন। এবার পুরুষের সার্বিক সহযোগিতায় নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে এবং অনানুষ্ঠানিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করতে হবে। মুসলিমা এখন উপজেলা ও জেলা অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও সমন্বয়শীল হলে তার দল যদি আগামীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তাহলে তিনি আগামী দিনে নাটোর সদর উপজেলা পরিষদে মহিলা ভাইসচেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশ নিতে চান।