8.9 C
New York
Friday, August 8, 2025
No menu items!
Homeবিশেষ সংবাদবীরাঙ্গনা এক অপরাজিতা রুবিয়া বেগম

বীরাঙ্গনা এক অপরাজিতা রুবিয়া বেগম

প্রান্তজন রিপোর্ট: সাম্য ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত এই দুটি কবিতার লাইনের মাধ্যমেই এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে যে পৃথিবীর যে কোন দেশ, রাষ্ট্র বা সমাজ গঠনের আন্দোলনে, সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে, সংস্কৃতির বিকাশে তথা সকল ইতিবাচক বা জনহিতকর কাজে শুধু নির্দিষ্ট একটি লৈঙ্গিক শ্রেণি অর্থাৎ পুরুষ সমাজ প্রতিনিধিত্ব করে না বরং প্রতিনিধিত্ব করে মানুষ যেখানে একজন পুরুষের যতটুকু অবদান থাকে একজন নারীরও ঠিক ততটুকু অবদান থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সমাজ বা রাষ্ট্রের ন্যায় সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা বাংলাদেশেরও রয়েছে অনেক গৌরবময় ইতিহাস। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরাবান্বিত ও স্মরণীয় ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙ্গালি মুক্তিকামী জনগণ ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে অর্জিত বিজয় আমাদের জন্য যতটা আনন্দের,পাশাপাশি ছিল আমাদের জন্য বেদনার ও দুঃখের। কেননা অনেক প্রাণের বিসর্জন ও রক্তবন্যায় আমরা অর্জন করেছিলাম বাংলাদেশ নামক এই সুন্দর রাষ্ট্র। এই মহান সংগ্রামে পুরুষদের অবদানের কথা যতটা জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, নারীদের ভূমিকার কথা সেভাবে উপস্থাপিত হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে অনেক সাহসী নারী রণাঙ্গনে শত্রুবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়, আশ্রয় ও খাবার প্রদান, গুপ্তচর হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শত্রুপক্ষ সম্পর্কে তথ্য দেয়ার মতো দুঃসাহসিক কাজে জড়িত ছিলেন তারা।তাদের মধ্যেই একজন নাটোরের রুবিয়া বেগম।বীর মুক্তিযোদ্ধা রুবিয়া বেগম নাটোর সদর উপজেলার বড়হরিশপুর ইউনিয়নের কামারদিয়াড় গ্রামের বাসিন্দা। বীর মুক্তিযোদ্ধা রুবিয়া বেগম একজন সাহসী নারী। তার জন্ম বগুড়ায়। কিশোরীকাল থেকেই তার মধ্যে নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলি ছিলো। স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন সময় তিনি গার্লস গাইডের নেত্রী ছিলেন।তবে তিনি শিকার হয়েছিলেন বাল্যবিয়ের। তিনি যখন নবম শ্রেণির ছাত্রী তখন তাঁর বিয়ে হয়।সংসারের অভাব অনটনের মধ্যে তিনি টিউশনি শুরু করে সংসার চালানো শুরু করেন।এরই মধ্যে দেশে নেমে আসে পাক শাসনের নামে শোষণের চূড়ান্ত স্ট্রিমরোলার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মার্চে যখন চলছিলো অসহযোগ আন্দোলন, তখন রুবিয়া বেগম নাটোর আনসার ক্যাম্পে বাবুর্চির কাজ করেন। সেসময় আনসার ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন একজন বাঙালি। তাই তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন। এই ক্যাম্পে গোপনে তিনি মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিতেন। অদুরেই পুরাতন রানীভবানী কলেজ (বর্তমান জেলেপাড়া মন্দির) ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। একদিন আনসার কমান্ডার রুবিয়া বেগমকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে ভাত রান্না করে দেবার অনুরোধ করেন। তার কথা মতো রুবিয়া বেগম মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যাতায়াত শুরু করেন। রান্নার পাশাপাশি অসুস্থ যোদ্ধাদের সেবাযত্ন করেন তিনি। এরই মধ্যে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পর মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নির্দেশে অনানুষ্ঠানিক লড়াই শুরু করে। এ লড়াইয়ে অংশ নেন রুবিয়া বেগমও।তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে লালপুরের ওয়ালিয়া, নলডাঙ্গার খাজুরা ও সদরের বালিয়াডাঙ্গা এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন।ডিসেম্বরের শুরুতে গোলবারুদ শেষ হওয়ার এক পর্যায়ে পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়েন রুবিয়া। তাকে ধরে এনে ক্যাম্পে অনান্য নারী বন্দীদের সাথে রাখা হয়। নারী মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় সেখানে তাকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে গুনারিগ্রামে লাল মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর আরেকটা লড়াই শুরু হয় রুবিয়ার। তার স্বামী তাকে ঘরে তুলতে না চাইলেও শ্বাশুড়ি জয়গুণ বেগম তাকে ঘরে তোলেন। সদ্য বিজয় অর্জিত দেশে কর্মের অভাবে নিদারুণ কষ্টের জীবনযাপন শুরু হয় রুবিয়ার। তখন তিনি সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন এবং এক মেয়ে ও ৪ ছেলেকে লালন পালন শুরু করেন। তবে তার মধ্যে মানুষকে সাহায্য করার প্রবণতা ছিলো অনেক বেশি। সাহসিকতা ও সহমর্মিতার গুণকে ধারণ করায় সিলেকশনে তিনি দু’বার ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে তিনি ভোটে সংরক্ষিত ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। তখন থেকেই রুবিয়া বেগমের যোগাযোগ অপরাজিতার সাথে। ইউপি সদস্য হিসেবে বিভিন্ন দাপ্তরিক কর্মকান্ডে যে প্রশিক্ষণ দরকার ছিলো তা প্রদানে পাশে দাঁড়ায় অপরাজিতা। আকস্মিকভাবে সেসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা সফরের অংশ হিসেবে নাটোরে আসেন সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত মেরি হোবলে। তিনি নাটোরের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিদর্শন করেন। তার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন রুবিয়া বেগম। কুষ্টিয়া, নওগাঁ, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে অংশ নেন রুবিয়া। তিনি বিভিন্ন যায়গা সম্মাননা পেয়েছেন যাদের মধ্যে রয়েছে ২০১৮ সালের রাজশাহী বিভাগের শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা, ২০১৭ সালের নাটোর জেলা ও সদর উপজেলা জয়িতা সম্মাননা, নিরাপদ সদক সম্মাননা, ৭১ এর বীরঙ্গনা সম্মাননা, মহিলা বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননাসহ অনান্য সম্মাননা। বীর মুক্তিযোদ্ধা রুবিয়া বেগম বলেন, তার আর চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই। দেশের জন্য লড়াই করাটাই বড় তৃপ্তির। ভবিষ্যতে আর জনপ্রতিনিধিত্ব করতে চান না। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন অপরাজিতা হিসাবেই নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করবেন তিনি। শেষ জীবন সকলের ভালোবাসা নিয়ে কাটাতে চান।

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments