রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা এখন ও মনে পড়লে শিউরে উঠি আমি। খুব একটা বাপের বাড়িতে যাওয়া হয় না আমার। দুই বছরে খুব বেশি হলে একবার। জীবনের ৮বছর কাটিয়েছি আমি রাজশাহীতে। রাবি থেকেই পড়াশুনা। সেই সময় সেশনজট ছিল অনেক বেশি। মা বলত, আর কবে পাশ করে বের হবি। আমি বলতাম মা ধৈর্য্য ধর। এইতো শেষ। নিভা স্বপ্না পুস্প, আশা ফেন্সি, মুক্তা, আমরা সবাই একই বিষয় নিয়ে পড়তাম। ওদের সাথে আমার এখন ও সম্পর্ক আছে। কিন্তু সুমির সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের ছিল না, তাহলে কেন এত খারাপ লাগে? আজও ভুলতে পারি না আমিওকে। সেই দিন, সেই আকাশ, সেই স্মৃতি সবই বার বার মনে করিয়ে দেয় ওর কথা।
নভেম্বর মাসের ১০তারিখ ক্লাস শেষ করে হলে ফিরছিলাম। তখন পিছনে থেকে আমাকে কে যেনো ডাকছে
এই এই শোন। আমি ঘুরে দেখি আমার মতই একজন। আমি দাঁড়ালাম বললাম, কিছু বললে আমাকে। প্রথম কথাতেই আমাকে বলল আমার বন্ধু হবে। হাহা করে হাসি। খুব অদ্ভুত লেগেছিল আমার সেদিন। নিজে থেকেই জানতে চেয়েছিল আমি কোন হলে থাকি। আমি বললাম, রোকেয়া হলে। এটা শোনার পর সে যে একটা কি আনন্দ আমাকে জড়িয়ে ধরে, বলেÑ বন্ধু চল আজ একসাথে থাকব। তুমি ৪১৬, আমি ৪২০। রাতে শুধু গল্প আর গল্প হবে।
আমার বেশ লাগছিল সুমির এই আন্তরিকতা দেখে। খুব একাকী লাগত। যদিও আমি আমার এক দুঃসম্পর্কের বোনের কাছে থাকতাম কিন্তু তারা আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতো না। সকালে চা খেয়ে ক্লাসে যেতাম তারপর দুপুরে রুমে সবজি আর ছোট মাছ দিয়ে ভাত। একই রান্না একই মেনু প্রতিদিন ভালো লাগত না। সুমির সাথে পরিচয় হবার পর থেকে আমি খুব আনন্দে থাকতাম। রাতে সুমির রুমে বসতো গল্প আর সংগীতের আসর।
গণিতের ছাত্রী ছিল সুমি। বাবা ও মায়ের একমাত্র সন্তান। সবসময় মুখে তার হাসি লেগেই থাকতো। সেই সময়ে আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের জন্য একটা নতুনহল হয়েছিল। নাম ছিল খালেদা জিয়া হল। সেই হলেই পরবর্তীতে আমি ও সুমি সিট পাই। আমার অন্য বান্ধবীরা তাপসী রাবেয়া হলে থাকতো। সুমি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবার মন জয় করে নিয়েছিল। যতদিন যায় সুমির সাথে আমাদের কয়েকজন বান্ধবীর সম্পর্ক গভীর হতে থাকে।
দিন গড়িয়ে বছর। সুমির সাথে সম্পর্ক আরো ঘণিষ্ঠ হতে থাকে। আমি জানতে পারি সুমি সাজ্জাদ নামে একটি ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। সাজ্জদ ভাই আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। আমাদের চেয়ে বয়সে দুই বা তিন বছরের বড় হবে সাজ্জাদ ভাই। পাঠান বংশের ছেলে ছিল সাজ্জাদ ভাই। অনেক বেশি সুন্দর ছিল সাজ্জাদ ভাই।
শুধু সুন্দর না ব্যবহার ও ছিল তার নমনীয়। দুজনের বোঝা পড়া ছিল দেখার মতো। দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ২০ শে মার্চ। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু হবে। দুপুর একটা থেকে। নতুন হল খালেদা জিয়া হলে সবে মাত্র কয়েক দিন হলো এসেছি। নতুন পরিবেশ নতুন রুম অনেক ভালো লাগত। সেই সাথে প্রভোস্ট ম্যাডামের মনোভাব ছিল ছাত্রীদের প্রতি সবার নজরে পড়ার মতো।
পরীক্ষা শুরু হবার আধাঘন্টা আগে আমি ও সুমি রুম থেকে বের হলাম। সে ছিল গণিতের ছাত্রী। রিকশায় যেতে যেতে সুমি আমাকে বলছিল, সে সব সূত্র মনে রাখতে পারছে না। কি যে হবে তার! বাণিজ্য ভবনে আমাকে নামিয়ে দিয়ে সে চলে যায় তার অনুষদে। পরীক্ষা শেষে আমি ও নীভা ঘরে ফিরি প্রতিদিনের মতো। কিন্তু সুমি আসে না। রাত ৮টার পরে আমরা কয়েকজন মিলে প্রভোস্ট সুলতানা ম্যাডামের কাছে যাই এবং সুমি যে এখনও হলে আসে নাই সেটা জানাই।
শুরু হয় খোঁজ। সাজ্জাদ ভাই কে আমরা জানাই। কিন্তু তখনো প্রকাশ পায়নি আসল ঘটনা। সাজ্জাদ ভাই কি জানতো সুমি কেন হারিয়ে গেল। কি আঘাত দিয়েছিল ভালোবাসার মানুষ তাকে। পরীক্ষা শেষ করে সুমি এসেছিল সাজ্জাদ ভাইয়ের কাছে। ভেবেছিল তার বিপদের ঘটনা জেনে তার ভালোবাসার মানুষ তাকে সাহস দেবে। সাহস তো দূরের কথা, সাজ্জাদ ভাইয়ের মুখ থেকে যে শব্দ এসেছিল, সেটা সে সহ্য করতে পারেনি। পারেনি নিজেকে ধরে রাখতে। নিজেকে সপে দিয়েছিল অজানা পথে।
কি ছিল সেই ঘটনা। অয়নদার কাছে থেকে আমরা যতটুকু জেনেছিলাম সেটা হলো পরীক্ষা হলে পেনের উপরে সুমি কিছু সূত্র লিখেছিল, যেটা পরীক্ষা শেষ হবার দশমিনিট আগে শিক্ষকের নজরে পড়ে এবং সুমিকে বহিষ্কার করা হয়। সুমিতো প্রথম বর্ষে প্রথম ছিলো, তাহলে কেন সে এ কাজ করলো। পেনটি সুমি পরীক্ষা হলে তার বান্ধবী অনুর কাছে থেকে নিয়েছিল। কিন্তু সে কথা সাহস করে বলতে পারেনি শিক্ষককে। মনের ভিতরে অনেক কষ্ট নিয়ে সুমি সাজ্জাদ ভাইয়ের কাছে প্রথম গিয়েছিল। অনুরোধ করছিল, পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে যেতে এবং প্রকৃত ঘটনা তদন্ত করে দেখার জন্য প্রার্থনা জানাতে। উত্তরে পেয়েছিল সে পাঠান বংশের ছেলে। সে এটা করতে পারবে না। আগামীতে তার সাথে সম্পর্ক রাখতে গেলে তাকে চিন্তা করতে হবে।
সুমি বলেছিল, সাজ্জাদ ভাইকে সম্পর্কটি ধরে রাখার জন্য। সাজ্জাদ ভাই, কোন উত্তর না দিয়ে তার বন্ধু হারুন ভাইয়ের সঙ্গে হলের ভিতরে চলে গিয়েছিল। হারুন ভাই সব জানতো। উনার কাছে থেকে আমরা সব জানতে পেরেছি। রাত দশটা
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকিংএ চলে হারানো সংবাদ। আর লিখতে পারি না। ফুলের মতো একটি মেয়ে যে গান গাইত, রুমে বসেÑ
আমার বুকের মধ্যে খানে
মধ্যে খানে হৃদয় যেখানে,
সেখানে তোমাকে আমি
রেখেছি কতনা যতনে।
… আমি বলতাম কাকে রেখেছিস!
হেসে বলতো, বলব না। তারপর হা হা করে হাসতো…
খালেদা জিয়া হলের পেছনে ছিল গভীর অরণ্য। পিছনে ছিল পুকুর। সন্ধ্যার পর থেকে সুমি হলের পিছনে গভীর জঙ্গলের মধ্যে বসে ছিল। কেউ জানতে পারেনি। সিসি ক্যামেয়ায় যা দেখা যায় সেটা হলো সুমি মাথায় উড়না দিয়ে হল থেকে বের হয়েছিল পরদিন সকাল ৭টার দিকে ।
কাজলা নামটি সবার পরিচিতি। রাবি অনেক ছাত্র ছাত্রী এখান থেকে বাসে উঠে নিজেদের বাসায় যাবার জন্য। সেই সময় সমীরদা নামে একজন বড়ভাই বসবাস করতো কাজলাতে তার পরিবারসহ। উনি রাবি ছাত্র/ছাত্রীদের পড়াতেন বাণিজ্য অনুষদের গণিতের বিষয়গুলো। আমিও পড়েছি দাদার কাছে। দাদা আমার দিক থেকেই সুমিকে চিনতো। আমার প্রাইভেট পড়ে যেতে দেরি হলে সে চলে আসতো দাদার বাসায়। দাদা সকাল ৭.৩০ দিকে সুমিকে দেখেছিল দাঁড়িয়ে থাকতে। দাদা জানত না সবকিছু। দাদাকে সুমি বলেছিল কিছু জরুরী কাজে সে শহরে যাবে। দাদা চলে যাবার ঠিক ১৫ মিনিটের মধ্যেই সুমি দ্রুত বেগে আসা মালবাহী একটি ট্রাকের সামনে গিয়ে নিজেকে সপে দেয় মৃত্যুর দিকে। লোকজনের চিৎকার শুনে সমীরদা ঘুরে এসে দেখে সুমির খণ্ডিত দেহ পড়ে আছে রাস্তায়। দাদা প্রথম ফোন দেয় স্বপ্নাকে। আমরা সবাই জানতে পারি স্বপ্নার কাছে থেকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু থমকে যায় সেদিন। সুমির খণ্ডিত দেহ নিয়ে প্রথমে আমরা যাই শহীদ মিনারে। সেখানে রাবির অনেক গণ্যমান্য শিক্ষকরা এসেছিল। তাদের চোখের চাহনি ছিল সুমির প্রতি অন্যরকম কিন্তু মুখের ভাষা ছিল বড় ভুল হয়ে গেছে কর্তৃপক্ষের। আমরা প্রায় ১০ জনের মতো বন্ধুরা ওকে নিয়ে যাই তাঁর দেশ ফরিদপুরে। সেখানে তাকে কবর দেয়া হয়।
সময় চলে তাঁর আপন নিয়মে। মানুষ অনেককিছুরই ভুলে যায়। কিন্তু সুমির মতো মেয়েদের স্মৃতি কেউ ভুলতে পারে না। আমি আজও পারিনা তাঁকে ভুলতে।পিছনে থেকে মনে পড়ে কে যেনি ডাকছে আমার বন্ধু হবে। আমার বুকের মধ্যে খানে ওকে রেখেছি অতি যত্নে। সে আজও বেঁচে আছে আমার কাছে।
লেখক: জয়শ্রী মোহন তালুকদার, তিনি নাটোর সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরবর্তীতে নাটোর জেলা শিক্ষা অফিসার মদন মোহন তালুকদারের কন্যা। বর্তমানে তিনি সিলেটে বসবাস করেন।