প্রান্তজন রিপোর্ট: সামাজিক অনাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করে অন্য নারীদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন নাটোরের লাইলী বেগম। কঠোর পরিশ্রম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন ও দৃঢ়তার প্রত্যয় নিয়ে লাইলী বেগম কাজ করে যাচ্ছেন নারীদের জন্য। নিজের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করে অর্ধশতাধিক নারীর সামাজিক মর্যাদার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে রেখেছেন অগ্রগণ্য ভূমিকা। এই কাজে মিলেছে তার একাধিক স্বীকৃতিও। জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা, সেরা মায়ের মতো সম্মাননা রয়েছে তার অর্জনের ঝুলিতে। মাত্র ৮ম শ্রেণি পাশ লাইলী বেগম এক রুঢ় সামাজিক নির্মমতার শিকার হন। লঙ্ঘিত হয় তার মানবাধিকার। দারিদ্রপীড়িত পরিবারের পক্ষে রুখে দাঁড়ানোর মতো কঠিন পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেন লাইলী। এই লড়াকু মনোভাব লাইলীকে উদবুদ্ধ করে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় অটুট থাকার দীক্ষায়। যে কোন বিপদ বা প্রয়োজনে এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পরিচিত হন সবার মাঝে। এলাকায় প্রতিবাদী ও লড়াকু নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া লাইলি প্রথম নজরে আসেন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী আব্দুল ওয়াহাবের। সমাজের নির্যাতিত ও অসহায় নারীদের পাশা দাঁড়ানো লাইলীর মহান ব্রতকে স্বীকৃতি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন আব্দুল ওহায়াব।লাইলি এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে এবার আরো দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করেন। এই অবস্থায় লাইলি পরিচিত হন অপরাজিতা প্রকল্পের সাথে। ২০১১ সালে লাইলী আনুষ্ঠানিকভাবে সংস্পর্শে আসেন অপরাজিতা প্রকল্পের। অপরাজিতা প্রকল্পের মাধ্যমে যেন লাইলি এলেন আরো বেশি আলোর সংস্পর্শে। ধীরে ধীরে তাদের কার্যক্রমে লাইলী সম্পৃক্ত হন। এরই মাঝে ২০১১ সালে স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেন। সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য হিসেবে নাটোর সদর উপজেলার তেবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৪,৫ও ৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন লাইলী। তবে ওই নির্বাচনে সামান্য ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হন। অপরাজিতা প্রকল্পের প্রেরনায় পরের নির্বাচন লাইলীকে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করে জনপ্রতিনিধিত্বে নিজেকে সম্পৃক্ত করার আকাঙ্খায়। এই অবস্থায় দেশের বিভিন্নস্থানে অপরাজিতা নারীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দিয়ে তাকে সামাজিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে। মেহেরপুর, দিনাজপুর খুলনাসহ নানা জেলায় অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে লাইলী সম্যক ধারণার পাশাপাশি বাস্তব জ্ঞান অর্জন করেন। এখান থেকে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন উদ্যমে নিজ এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন তিনি। ২০১৬ সালে পুনরায় ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে চার জনকে পরাজিত করে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। শুরু হয় নতুন উদ্যমের সাথে পথ চলা। লাইলী স্থানীয় সরকার পরিচালনার আইন,বিধিবিধানসহ খুঁটিনাটি বিষয়ে ধারনা লাভ করেন অপরাজিতা প্রকল্পের মাধ্যমে। অর্জিত এই জ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগ দেখান ইউপি সদস্য হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী কমিটির পরিচালনায় সভাপতি হিসেবে। পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা ছাড়া বাকী সব বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকায় সুচারুরুপে দায়িত্ব পালন করেন লাইলী। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে নাগরিক চাহিদা পূরণে ভূমিকা পালন করেন। লাইলীর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো বেশ কিছু সদগুণ দ্বারা প্রভাবিত হন স্থানীয় অবহেলিত নারী সমাজও। লাইলী দেখেন একজন ইউপি সদস্য হিসেবে এলাকাবাসীর সাধারণ প্রয়োজন মেটাতে পারলেও আর্থিক সমস্যাগুলো মেটানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সংসারের আর্থিক কাঠামো দুর্বল হলে পদে পদে যে দুর্বিষহ পরিস্থিতি নেমে আসে তা পূর্বে থেকে আঁচ করতে পারা লাইলী চিন্তা করেন নিজ উদ্যোগে সহায়তা করার। এরই মাঝে নেমে আসে মহামারী করোনা পরিস্থিতি। সবকিছু থেমে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ভেঙে পড়েন লাইলী। এতে তিনি ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়েও পরাজিত হন। করোনাকালের ভয়াবহ দুঃসময়ে নিজ পরিবার ও এলাকার নারীদের আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য অপরাজিতা প্রকল্প কর্মীদের অনুপ্রেরনায় গঠন করেন পশ্চিম বড়গাছা নারী কল্যান সমিতি। কুটির শিল্পপ্রধান এই সমিতিতে নকশীকাঁথা, জায়নামাজ, পাটির মতো শৌখিন সামগ্রী প্রস্ততের কাজ হাতে নিয়ে নিজ পরিবার ও অনান্য নারীদের জন্য আয়বর্ধক কর্মকান্ডের প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমিতিকে প্রতিষ্ঠিত করেন লাইলী। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন নারী কাজ করে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনেছেন নিজেদের পরিবারে।শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালে জেলা গার্লস গাইড এসোসিয়েশন লাইলীকে ‘সেরা মা’ এবং ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসে জয়িতা পদকে ভুষিত করেছে। লাইলী কৃতজ্ঞতা চিত্তে বলেন, মানুষ অন্যের জন্য কাজ করতে চাইলে তাকে আগে জানতে হবে কাজের খুঁটিনাটি। মানুষের জন্য কাজ করার প্রবল ইচ্ছা আমার ছিলো।আমি সাধ্যমত করেছি।তবে যে সময় থেকে অপরাজিতার সংস্পর্শে এলাম সেসময় আমার চেষ্টা পূর্ণতা পেয়েছে।তাদের প্রশিক্ষণ, সফর ও সার্বিক সহায়তার কারনে আমি আমার কাজকে সহজ করতে পেরেছি। অপরাজিতা উপজেলা নেটওয়ার্কের সভাপতি হিসাবে নাটোর সদর উপজেলার দায়িত্ব পালন করছেন লাইলী। আগামীতেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।