8.9 C
New York
Tuesday, November 18, 2025
No menu items!
Homeবিশেষ সংবাদসাধারণ নাজমার অসাধারণত্ব

সাধারণ নাজমার অসাধারণত্ব

প্রান্তজন রিপোর্ট:  জনসেবায় অনুকরণীয় তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন সাধারন নারী যে নিজের ও আশেপাশের এলাকার সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশার পীঠস্থান হতে পারেন তার অনন্য দৃষ্টান্ত নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার অদম্য নাজমা বেগম। একজন সাধারণ নারী হয়েও আচরণে, কর্মে, সহযোগিতায় কিংবা সহমর্মিতায় অসাধারণ হয়ে উঠেছেন তিনি। এই মুহূর্তে পরিচয় দেবার মতো পরিচয় না থাকলেও এই নারী ইতোমধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন নিজ এলাকা বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়ন বাসীর নিকট। শুধু এই গ্রহণযোগ্যতার পুঁজিতেই তিন মেয়াদে ১৫ বছর ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জনকল্যাণের ব্রত নিয়ে সর্বদা মানুষের পাশে দাঁড়ানো নাজমা প্রমাণ করেছেন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা থাকলে পদ-পদবী থাকা বা না থাকাটা জরুরি নয়। নলডাঙ্গা উপজেলার প্রবেশদ্বার ব্যস্ততম বাসুদেবপুর বাজারের পাশে বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। আশেপাশে অর্ধশত দোকানপাট।এসব দোকানগুলোই এখন বসার জায়গা হয়ে উঠেছে সাবেক সংরক্ষিত ইউপি সদস্য নাজমা বেগমের। গত ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সামান্য ভোটের ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন নাজমা বেগম। ফলে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে এখন আর তার বসার সুযোগ নেই। তবে তিনি নির্বাচিত না হতে পেরেও নিজেকে মানুষের নিকট থেকে গুটিয়ে নেননি। মানুষের আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতা তাকে এখনো মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে মনস্তাত্ত্বিক প্রেরণা যুগিয়ে চলছে। নাজমা বেগমের বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠায়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা ইস্তফা দিয়ে তাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল। আশির দশকের শুরুর দিকে দেশের সামাজিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ না থাকায় বিয়েতে দ্বিমত পোষন করতে পারেননি মা-বাবার সাথে। নাজমাকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে বাবার সংসারটা হালকা হলেও নতুন জীবনে অভাব ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাকে। নাজমা দুই সন্তানের মা হন। বছর খানেকের মধ্যে স্বামী মারা যান।স্বামীর রেখে যাওয়া যৎসামান্য অর্থের সাথে নিজের কষ্টের কিছু সঞ্চয় একত্রিত করে শুরু করেন গবাদিপশু পালন। নিজের সংসার ও সন্তানদের লালন পালন চলে সামান্য আয়ে। নাজমার দিনযাপন গ্রামের আর দশটা সাধারণ বধুর মত হলেও মানুষকে সহযোগিতা ও বিপদ-আপদে ছুঁটে যাওয়া তাকে খুব দ্রুত গ্রহণযোগ্য করে তোলে নিজ গ্রাম বিপ্রবেলঘড়িয়া চকপাড়াবাসীর কাছে। এলাকাবাসী তাদের যে কোন প্রয়োজনে ডাকলেই পান নাজমাকে।এভাবে বাড়তে থাকে মানুষের সাথে যোগাযোগ,গড়ে ওঠে হৃদ্যতা। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো এলাকার সর্বস্তরের মানুষের ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত ইউপি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নাজমা। প্রথমবারেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ইউনিয়ন পরিষদে বসার সুযোগ পেলেন। এরপর থেকে অবারিত হল সেবার দুয়ার। রাজনৈতিক কারনে ইউপি সাধারণ সদস্যরা জনগনের জন্য সবসময় নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারতেন না। কিন্ত একজন নারী সদস্য হওয়ায় তিনি নিজের নির্বাচিত তিনটি ওয়ার্ডের সেবা নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রদান করেন। প্রথমবার ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হলে বিনামূল্যের এই সেবা তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কাছে পৌছে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দায়িত্বশীল আচরণ ও ভোটারদের আশা আকাংখা পূরণ করায় ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে পুনরায় বিপুল ভোটে জয়ী হন নাজমা।
এবার তিনি ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইন করে সরকার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করলে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সুচারুরুপে এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দিনে দিনে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেলে ২০১৬ সালে তৃতীয়বারের মত ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে টানা চতুর্থ বারের মত ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন। তবে এবারে তিনি সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। নাজমা প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সমর্থিত হওয়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতায় তাকে পরাজিত হতে হয়। টানা তিনবারের নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি হওয়ায় নাজমার রয়েছে অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। তিনি জানান, স্থানীয় সরকার পরিচালনায় একজন সাধারণ সদস্যের চেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয় একজন সংরক্ষিত নারী সদস্যকে। এই বাস্তবতাকে কেউ মেনে নিতে চান না। যেখানে একজন পুরুষ সদস্য শুধু একটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করেন সেখানে একজন নারী সদস্য তার তিনগুন কাজ করছেন।পুরুষ সদস্যকে না পেলে নারী সদস্যের কাছেই আসে মানুষ। তারা দ্রুত সেবা চায় যা একজন নারীই পারে নিষ্ঠার সাথে দিতে। তবে নির্মম বাস্তবতা এই যে একজন নারী সদস্য সেবার ও সমন্বয়ের যে মানসিকতা নিয়ে কাজ করেন, একজন চেয়ারম্যান বা পুরুষ সদস্যর নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাননি। ফলে সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নে নারী চাইলেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। নাজমা বেগমের মতে, স্থানীয় সরকারে নারীদের শক্তিশালী করতে সবার আগে প্রয়োজন আর্থিক নিশ্চয়তা। অথচ বাস্তবতা এই যে গত তিন মেয়াদে একজন নারী সদস্যর সম্মানি বাবদ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বরাদ্দ অর্থ কখনোই তিনি পাননি। শুধু উপজেলা পরিষদের যৎসামান্য সম্মানিতে মানুষের সেবা তো দুরের কথা নিজের মৌলিক চাহিদাগুলোও পুরন করা যায় না। উপরন্ত এই অর্থ সর্বদা চেয়ারম্যান ও অন্য পুরুষ সদস্যরা ভাগাভাগি করে নেন। নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাজমা জানান, দলীয় সমর্থন পেলে আগামীতে নলডাংগা উপজেলা থেকে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করবেন না হলে দির্ঘদিনের জনপ্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালনের কারনে সাধারন আসনে নির্বাচনে অংশগ্রহনের ইচ্ছা পোষন করেন । কারন সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের পরিষদের সেবামুলক কাজ,ভোটারদের মন জয়, মূল্যায়ন,সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহনে কম সুযোগ থাকে। সবসময় মানুষের সেবাই করতে চান তিনি আগামী দিনগুলোতে। তবে বর্তমানে এ সেবাদান অব্যাহত রাখার জন্য নিজ বাড়িতে ছোট পরিসরে একটি কাপড়ের দোকান করেছেন তিনি। এই অর্থ তিনি মানুষের কল্যানে ব্যয় করছেন।
নাজমা বেগম বলেন, গত এক দশকে একজন ইউপি সদস্য হিসেবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের আওতা পরিধি, সার্বিক জ্ঞান, দক্ষতা,অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অপরাজিতা প্রকল্প অনেক সাহায্য করেছে। এই প্রকল্প সর্বস্তরের নারীদের তাদের অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ে সজাগ করে। ভবিষ্যতে এই প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধি পেলে সমাজ উপকৃত হবে।

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments