গল্পটা শুরু করতে চাই ২০১৮ সালের জামায়াতে ইসলামীর একটি সমাবেশ থেকে। সেখানে দলের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরোয়ার শরিক দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের একটি মন্তব্যের জবাব দিচ্ছিলেন। কাছাকাছি সময়ে ফখরুল সাহেব এক বক্তৃতায় তাদের জোট নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে বিএনপির কারো সহায়তার দরকার নেই” এরই জবাব দিচ্ছিলেন গোলাম পরোয়ার। তিনি পরিস্কার করেই বলেন,“আমি মনে করিয়ে দিতে চাই ১৯৯১ এর নির্বাচনের কথা। সেসময়ও বিএনপি-জামায়াত জোট হওয়ার কথা হচ্ছিল। জামায়াত ১০০ আসন চেয়েছিল। আপনারা রাজি হননি। তাই লিখিত জোট হয়নি। জোটটি হয়েছিল অলিখিত। আপনারা ৩৯টি আসনে জামায়াতের সঙ্গে কাজ করার কথা বলে বাকি ২৬১ আসনে জামায়াতের সহায়তা নিয়েছিলেন এবং সেদিন ক্ষমতায় গিয়েছিলেন। সে দিন কোথায় ছিল আপনাদের এই দম্ভ?”
গোলাম পরোয়ারের ৩০ বছরের পুরোনো স্মৃতি চারণে বের হয়ে আসলো অনেক না বলা কথা। যে অলিখিত জোটের কথা তিনি বলছিলেন সেটা আসলে জোট নয় সম্পর্ক। শুধু সম্পর্ক নয় খুব কাছের সম্পর্ক। আমি আসলে বলবো এটা দুই ভাইয়ের এক সঙ্গে পথ চলার মত। যে চলায় ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্য হয় কখনো কখনো। কিন্তু এই মালিন্য হাইকমাণ্ডের নির্দেশে মুহূর্তেই ঠিক হয় সব সময়। এখানে অবশ্য হয় না বলে, হয়ে যেতে বাধ্য বলাই ভাল। কারণ তাদের একজনের কাছে আরেকজনের মত এমন নিরপদ আশ্রয় আর তো নেই। কী পাঠক, বেশি বেশি মনে হচ্ছে? তাহলে চলেন এই ভাইদের জন্মবৃত্তান্ত জেনে আসি।
সময়টা ১৯৪৮। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ। পাকিস্তানে তখন সৃষ্টি হলো দুটো গোয়েন্দা সংস্থা। একটা হচ্ছে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) এবং ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আএসআই )। আজকের বাংলাদেশ তখন পূর্বপাকিস্তান। এর কাজ ছিল মূল ইসলাম ধর্মের আড়াল মৌলবাদ ছড়ানো এবং ধর্মের উদার নৈতিক দিকগুলো সাধারণ মানুষের কাছে আড়াল করে পাকিস্তানের আধিপত্যবাদ বজায় রাখা। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক K. Matinuddin এর লেখা Tragedy of Errors: East Pakistan Crisis এর বর্ননা অনুযায়ী ১৯৫০ সালেই আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে আইএসআইয়ের নেটওয়ার্ক তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু ২০০৭ সালে প্রকাশিত Diaries of Field Marshal Mohammad Ayub Khan পড়লে দেখা যায়, ফয়েজ হোসেনের নেতৃত্বে ছয়জন নৌ-অফিসার আইয়ুব খানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। এদের সঙ্গে আএসআই এর সম্পর্ক ছিল। এখানে একটি চরম সত্য তুলে এনেছেন Hein G. Kiessling। তার লেখা Faith, Unity, Discipline: The ISI of Pakistan এ তিনি ওই নৌ-অফিসারদের হত্যা পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। সেই পরিকল্পনায় ছিল, আইয়ুব খানকে হত্যার পর জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদীকে করা হবে আইনমন্ত্রী, মৌলভী ফরিদকে বানানো হবে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর এবং জেনারেল আযম হবে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। সুতরাং বোঝাই যায় আএসআই এর জন্ম ইসলামী মৌলবাদের ঔরসে। আরও পরিস্কার হয়ে যায় এই সংগঠনটি শুরু থেকেই জামায়াত নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।
পাঠক এরই মধ্যে নিশ্চয়ই বুঝেছেন আইএসআই আমাদের আলোচিত পিতা। তারই বড় ছেলে জামাতে ইসলামী। তাহলে আরেক ভাই কই? আমরা তো লেখার শুরুতে দুইভাইয়ের কথা বলছিলাম। আসছি সেই প্রসঙ্গে। তার আগে আইয়ুব খানের কাছে ফিরি। মৌলবাদ ছড়ানোর যে রাজনৈতিক দর্শনও তিনি আইএসআই গঠন করেছিলেন সেখানে তার অজান্তেই মুসলিম লীগ ও জামায়াতের কঠোর দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। কিন্তু এতটাই সুক্ষ্মভাবে হলো যে তিনি প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারলেন না। জামায়াত নেতৃত্ব থেকেই গেলো আইএসআইএ এক সময় আইএসআইয়ের পাঞ্জাব এবং পশতু নেতৃত্ব চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলকে বেছে নিল, পূর্ব পাকিস্তানে আইএসআই অপারেশন কেন্দ্র হিসেবে। ততদিনে আমাদের বগুড়ার ছেলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যোগ দিয়েছেন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। তিনি ১৯৫৩ সালে কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগ দিয়ে ১৯৫৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশনও পেয়ে গেছেন। ১৯৫৭ সালে তাকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেন সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীতে। অর্থাৎ আইএসআই এর হয়ে কাজও করে ফেলেছেন। এসময়ই তার টিমে যুক্ত হন বাঙালি অফিসার নূরুল ইসলাম শিশু এবং সাদেকুর রহমান চৌধুরী। বলা হয় ওই সময়ই এই তিন অফিসার মগজে গেঁথে নেন আইএসআ্ই এর দর্শন। যা তারা সারা জীবন ভোলেননি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিয়াউর রহমানকে ‘মেজর’ পদে উন্নীত করে অস্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে চট্টগ্রাম বদলি করে। কারণ ভারতকে চাপে রাখার জন্য আইএসআইয়ের শক্ত নিয়ন্ত্রণ দরকার ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে। আমার রাজনীতির রূপরেখা নামের সম্পাদনা বইয়ে জিয়া নিজেই লিখেছেন “১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে জিএসও-১ (গোয়েন্দা) লে. কর্নেল তাজ আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কয়েকজন সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চান। আমি তার এসব তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি আমাকে জানান, তারা বাঙালি নেতাদের জীবনী সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে। আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করি, ‘এসব খুঁটিনাটির প্রয়োজন কি?’ এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারায় কাজে লাগাবো।’
একই বইয়ের ১৬-২১ পৃষ্ঠায় জিয়ার লেখা থেকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, “১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছিল, তখন তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বিহারিদের বাড়িগুলোতে জমা করছে। তরুণ বিহারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এমনকি বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে বাঙালিপাড়ায় যাচ্ছে এবং নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করছে” কিন্তু ওই সময় তার সমানে এসব অন্যায়ের ন্যূনতম প্রতিবাদের নজির কোথাও পাওয়া যায় না।
এই জিয়া আইএসআই এর ছোট ছেলের আসল চরিত্রে বেরিয়ে আসেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। বাংলাদেশ নিয়ে আইএসআই যে কয়টি প্রকল্প নিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সব নস্যাৎ হয়ে গেলো। যে দর্শন মাথার মধ্যে ঘুরছে সেটা কোথায় যাবে? সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্য যোগাযোগ বন্ধ রাখলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ফিরে গেলেন আগের ফর্মে। ১৯৭৬ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার পর তার প্রধান সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলেন সেই বিশ্বস্ত বন্ধু নুরুল ইসলাম শিশুকে। ১৯৭৭ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর শিশুকে বানালেন,বন ও কৃষি মন্ত্রী।
আরেক বিশ্বস্ত এজেন্ট সাদেকুর রহমান চৌধুরীকেও দ্রুত কাছে টানলেন জিয়া। মেজর জেনারেল হয়ে সাদেকুর রহমান চৌধুরী রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন কিছু দিন। এই সাদেক এবং শিশুর সহায়তায় বঙ্গবন্ধুর প্রত্যেক হত্যাকারীকে দায়মুক্তি এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। মৃত্যুদণ্ডের কিছুদিন আগে সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাতকারে একথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ক্যপ্টেন মাজেদ।
আইএস আইএর কাজ হিসাবে জামায়াতের পুনর্বাসন করেন জিয়া। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ১৯৭৬ একটি অধ্যাদেশ জারি করান রাষ্ট্রপতি সায়েমকে দিয়ে।এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৩৮ ধারা বাতিল করেন। যে ধারায় বলা ছিল বাংলাদেশে কেউ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে পারবে না। পরতপক্ষে তিনি বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার পথ খুলে দিয়েছিলেন সেদিন। বড় ভাই আর কত দিন রাজনীতির বাইরে থাকবে? ১৯৭৬ সালেই ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি রাজনৈতিক প্লাটফরমে ধর্মীয় রাজনীতি শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে ৬টি আসন নিয়ে তারা পবিত্র সংসদে ঢোকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মৌলবাদীরা। ওই ১৯৭৯ সালেই ঢাকার একটি হোটেলে তিন দিন ধরে সম্মেলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে জামায়াতে ইসলামী।
সশস্ত্রবাহিনীতে বিভিন্ন ইস্যুতে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হত্যার মধ্য দিয়ে গোটা সশস্ত্রবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আতঙ্ক হয়ে ওঠেন জিয়া। সবাই তখন বুঝতো আইএসআই এর দর্শন এগিয়ে নিচ্ছেন জিয়া। কারণ ততদিনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জেলা থেকে বেছে বেছে সেটেলার নিয়ে বসিয়েছেন। কারণ আইএসআই, এর অস্ত্র পাঠানোর দরকার হচ্ছিল নাগাল্যান্ডের কাছে। এরই শেষ ধারাবিহিকতা চট্টগ্রামে ১০ট্রাক অস্ত্র। এরই মধ্যে প্রকাশ্যে সেসব কথা অস্ত্র গ্রহিতা অনুপ চেটিয়া বলে দিয়েছেন। আমরা জেনে গেছি কারা কিভাবে অস্ত্র পাঠানোর রুট তৈরি করেছিল। সেখানেও বার বার আইএসআই বিএনপি এবং জামায়াতের নাম এসেছে।
লেখাটি শেষ করবো চট্টগ্রামেই জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে। জিয়া হত্যার কয়েক দিনের মধ্যেই মেজর জেনারেল মঞ্জুরসহ কয়েকজন সামরিক অফিসারের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন এই হত্যাকাণ্ড তা প্রকাশ্য হয়নি ? প্রশ্ন হচ্ছে কেন হলো না? এমন কী বিএনপিও এই বিচার চায়নি। তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়েও টু শব্দটি করেননি। তারেক জিয়া নানা কথা বললেও, বাবা হত্যার বিচার কখনো চায়নি। কারণ কী, বিচার চাইতে গেলে তদন্ত হতো? সেখানে কি কি বেরিয়ে আসার ভয় ছিল? কাদের রাজনীতির মূল সূত্র প্রকাশ্য হতো ? মৃত্যুর পরেও কী বাঁচাতে হবে জামায়াতকে?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।