মোঃ আবুল কালাম আজাদ
টাকডুম্, টাকডুম্, টাকডুম্ টাক্, টাক্— শব্দে ঘন তালে ঢোল বাজিয়ে দাঁড়ি দাঁড় টানছে, আর যাত্রীরা দূরে ঢোলের শব্দ শুনে নদীর ঘাটে এসে ঊচ্চ শব্দে হাঁক ছেড়ে ডাকে, ঐ গয়নার নৌকা, ঘাটে নৌকা ভিড়াও, আমি/ আমরা যাবো। যাত্রীর ডাক শুনে মাঝি হাল ঘুরায়ে নৌকা যাত্রীর অবস্থানের ঘাটে নৌকা ভিড়ায়। আর দাঁড়িরা দাঁড় ছেড়ে লগি হাতে নিয়ে চলন্ত নৌকা নদীর স্রোতের বিপরীতে নৌকা নিয়ন্ত্রণ করে ধীরে ধীরে ঘাটে ভিড়ায়, যাতে কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। নৌকা ঘাটে ভিরলে আবার হাঁক ডাক শুরু হয়। তখনো কিছু যাত্রী ঘাটে এসে পৌছায়নি। এদিকে দাঁড়িরা আবারো টাকডুম, টাকডুম শব্দে নিজস্ব বাজনা বাজিয়ে জানান দেয় গহনার নৌকা ঘাটে ভিড়েছে তাড়তাড়ি চলে এসো। যাত্রী যদি মহিলা হয় তাহলেতো অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় কখন তারা ঘাটে এসে পৌঁছাবে। এদিকে যে ব্যাক্তি যাত্রীদের হয়ে ঘাটে এসে ডেকে গহনার নৌকা ঘাটে ভিড়ায়েছে তার জবাবদিহি করতে হয় নৌকার যাত্রীদের কাছে। এতে সে ছুটে দৌড় দেয় বিলম্বিত যাত্রীদের খোঁজে। আর নৌকার মাঝিরা মুর্হুমুহু ঢোল বাজায়ে জানান দিতে থাকে চলমান যাত্রীরা বিরক্ত হচ্ছে চট জলদি আসেন। সময়মত গন্তব্যে পৌছাতে হবে। ট্রেন ধরতে হবে। নৌকায় থাকা অন্যান্য যাত্রীরাও বারবার বিরক্তির সাথে তাগাদা দিতে থাকে। কোন কোন সময় যাত্রীদের চাপে যাত্রী ফেলে রেখে নৌকা ছেড়ে দিয়ে টানতে থাকে। এদিকে পিছিয়ে থাকা যাত্রীরা নৌকার পিছু পিছু হাঁক ডাক করতে করতে দৌড়োতে থাকে। উপায় না দেখে দয়াপরবশ হয়ে পুনরায় নৌকা ভিড়ায়ে যাত্রী উঠায়ে নেয়। তা নাহলে ঐ যাত্রীদেরকে একদিন অপেক্ষা করতে হবে। ফেলে রেখে যাওয়া যাত্রীদের কোর্টে মামলা থাকলে ক্ষতি হতে পারে এ আশংকায়। এমনিভাবে গয়নার নৌকায় ঘাটে ঘাটে ভিড়ায়ে যাত্রী উঠায়ে গন্তব্যে পৌঁছাত ।
হাঁ, সে কালের নদী পথে দূর পাল্লার যাত্রীবাহী গয়নার নৌকার কথা আমরা ভুলে গেছি । গয়নার নৌকার নাম শুনে বর্তমান প্রজন্ম নিশ্চয় ভাববে গয়নার নৌকা আবার কি ? সে নৌকা কী সোনা দিয়ে মোড়ানো ,না কি সোনার গয়না পড়ানো নৌকা ? না, গয়নার নৌকা কোন সোনা দিয়ে মোড়ানো নয়, আবার সোনার গয়নাও পড়ানো থাকেনা । এ নৌকা কাঠের ৬০/৭০ হাত লম্বা প্রায় সম্পূর্ন নৌকা বাঁশের ছই দ্বারা ছাউনি দিয়ে ঢাকা । যাতে রোদ-বৃস্টিতে যাত্রীরা না ভিজে বা কোন কস্ট না পায় ।এ ছাড়া নৌকার মাথা হতে পিছন পযর্ন্ত বাঁশের চারাট অথবা কাঠের তক্তার পাটাতন দ্বারা আবৃত যার উপড়ে যাত্রীরা সুবিধামত নিজ নিজ বিছানা বিছায়ে আরাম করে শুয়ে বা বসে ঘুমাতে বা বিশ্রাম নিতে পারে । যাত্রীদের প্রস্রাব/পায়খানার জন্য পিছন নৌকার গলুইয়ের নীচে পানি ছুই ছুই একটি বাঁশ ঝুলানো থাকতো । সামনের গলুইয়ের সামনে দাঁড় টানার জন্য কিছু অংশ ছই দেওয়া থাকতোনা । যাত্রীরা কেউ বিছানা বিছায়ে আয়েশ করে শুয়ে ঘুমাতো, কেউ কেউ একে অপরের সাথে বসে গল্পে সময় কাটাতো, কেউ সাথী ঠিক করে নিয়ে হারিকেনের ক্ষীন আলোয় তাস নিয়ে বসে যেত । আবার কেউ ছইয়ের উপড় উঠে খোলা বাতাসে বসে / শুয়ে থাকতো এবং গল্প করতো, কেউ মনের সুখে গান গাইতো । এদিকে রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নৌকার মাঝি মাল্লারা অত্যন্ত দক্ষতা এবং সাবধানে ঘাটে ঘাটে যাত্রী উঠায়ে নৌকা বাইয়ে বড়ালব্রীজ রেলস্টেশন ঘাটে কখন পৌছাতো যাত্রীরা বুঝতেই পারতোনা। ভোরে ট্রেন আসলে যার যার গন্তব্যে চলে যেত । আবার সারাদিন ঘাটে অস্থান করে সন্ধ্যা পযর্ন্ত শেষ ট্রেনের ফিরতি যাত্রী নিয়ে রাত্রে নদীর স্রোতের উজান বেয়ে চাঁচকৈর ঘাটে ফিরে আসতো। নদীর ভাটি যেতে হাল আর দাঁড় টেনে যেত আবার বড়ালব্রীজ থেকে চাঁচকৈড় উজান আসতে বাঁশের লগি ঠেলে, গুনটেনে আবার বাতাস থাকলে কাপড়ের বাদাম বা পাল উড়ায়ে আসতে হতো যা অনেক কস্ট সাধ্য ছিল । নির্দিস্ট সময়ে ঘাট থেকে গয়নার নৌকা ছেড়ে যেত আবার নির্দিস্ট সময়ের আগে পৌছাতে হতো । না হলে ভোরের ট্রেন ফেল করতে হতো সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে। এ গয়নার নৌকায় করে বরযাত্রী, কন্যা যাত্রী, নববধূ , ব্যবসায়ী, মামলার বাদী-আসামী সহ সব ধরনের যাত্রী যাতায়াত করতো। মাঝে মাঝে শোনা যেত রাত্রীতে বড়ালব্রীজ থেকে ফেরার পথে চাটমোহর উজেলার নিমিই চড়া নামক ফাঁকা বিলের মধ্যে গয়নার নৌকায় ডাকাতি হয়েছে। যাত্রীদের কাছে থাকা টাক পয়সা ঘড়ি সোনার গহনা, ব্যাবসায়ীদের মালামাল যা কিছু থাকে সবকিছু লুটে নিয়ে গেছে । এতে অনেক যাত্রী ডাকাতদের মারপিটে এবং ছুড়ির আঘাতে যখম হতো, নিহত হতো, আবার কোন কোন যাত্রী ডাকাতের ভয়ে নৌকা থেকে আত্মরক্ষার জন্য নদীতে ঝাঁপ দিয়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা করতো । অনেকে পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়ে যেতো এবং মারা যেতো। অনেককে খুঁজে পাওয়া যেতোনা। পড়ে যেত শোকের ছায়া। ডাকাত দলের লোকজন ছদ্মবেশে যাত্রী সেজে গহনার নৌকায় উঠে আসতো যা কেউ বুঝতে পারতোনা যে, কারা ডাকাত আর কারা সাধারণ যাত্রী। নিমায় চড়া ফাঁক জায়গায় আসলে যাত্রীদের কাছে অবস্থান নেওয়া ডাকাত দলের ছদ্মবেশী সদস্যরা তাদের কাছে থাকা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যাত্রীদের কাছে থাকা মালামাল লুট করে নিয়ে যেত। কোন কোন দিন সাহসী মাঝিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাকাত দলের ২/১ জন সদস্যকে আটক করতো এবং গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করতো। এছাড়া কোন সময় যাত্রীরা মাঝিদেরকে ডাকাত দলের সাথে যোগসাজস আছে সন্দেহ করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে অভিযোগ করলে পুলিশ মাঝিদের ধরে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো, সন্দেহ হলে আটক করে চালান দিত। এমনি ভাবে জানমালের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাবসায়ী সাধারণ নারী-পুরুষ যাত্রীসাধারণ নদীপথের একমাত্র বাহন গয়নার নৌকায় যাতায়াত করতো ।
’৮০-র দশক পযর্ন্ত পদ্মা থেকে বড়াল গুমানী, নারোদ, আত্রাই, নন্দকঁজা সহ প্রায় সকল নদ-নদীতে সাড়া বছর পানি থাকতো। যার ফলে যাত্রীবাহী গহনার নৌকায় যাত্রীরা চলাচল করতো। ব্যাবসায়ীরা ঢাকা, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর মোকাম থেকে ব্যাসায়িক মালামাল নিয়ে আসতো। এতে পরিবহন খরচ কম হতো । ব্যাবসায়ীরা লাভবান হতো ।
নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় বাজার ছিল সে সময়ের ব্যবসা বন্দর এবং ব্যবসা মোকাম বলে খ্যাত। চাঁচকৈড় থেকে প্রতিদিন নিয়মিত দিবা-রাত্রী বড়ালব্রীজ, নাটোরের হালসা- আহম্মেদপুর, বিলদহর সিংড়া এবং সিংড়া- বিলদহর থেকে বড়ালব্রীজ রেলস্টেশন পর্যন্ত নদী পথে গয়নার নৌকায় এ ভাবেই যাতায়াত করতো ।
সে সময় কোন গয়নার নৌকায় যন্ত্র বা শ্যালো মেশিনের ব্যবস্থা ছিলনা। শুধুমাত্র ভাটির দিকে যাওয়ার পথে মাঝির হালের কাচা এবং সামনের ২/৩ টি দাঁড়ির দাঁড় টেনে এবং উজান পথে বাঁশের লগি ঠেলে, গুন টেনে অথবা বাতাসে বাদাম বা পাল খাটায়ে নৌকা বাইতে হতো, যা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। আর যাত্রীরা কেউ বিছানা মেলে ঘুম পাড়তো, কেউ ছয়ের নিচে অথবা উপড়ে বসে নিজের, পরিবারের, রাজনীতির খোশ গল্প করে সময় কাটাতো। আবার কেউ ডাকাতের ভয়ে তটস্থ থাকতো । দূরপাল্লার যাত্রী হওয়ায় বেশিরভাগ যাত্রী খাবার বাড়ি থেকে বেঁধে নিয়ে আসতো অথবা গয়নার নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা করতো ।
আশির দশকের পর থেকে নদীতে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ, বড়ালের উৎস মুখে, আটঘড়িতে অপরিকল্পিত জলকপাট, আত্রাই নদীতে সাবগাড়ি রাবারড্যাম দেওয়ায় নদীগুলি বেশির ভাগ সময় পানিশুন্য থাকে। এখন নৌকা গুলি শ্যালো মেশিন দ্বারা যান্ত্রিক হওয়ায় এবং উন্নত সড়ক যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ায় আর সেকালের গয়নার নৌকা নদী পথে চলাচল করেনা । উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত জলকপাট, বাঁধ, রাবার ড্যাম নির্মান করে এবং নদীর দখল দূষনের ঠেলায় নদীগুলি নাব্যতা হারিয়ে মরে যাওয়ায় আমাদের সে জনপ্রিয় চির পরিচিত গয়নার নৗকা মানষপট থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে । বর্তমান প্রজন্মের কাছে গয়নার নৌকা নামের কোন দূরপাল্লার যাত্রীবাহী নৌকা আদৌ ছিল কিনা বলতে পারবেনা, যা সম্পূর্ণ এখন অতীত স্মৃতি।






