১১ জানুয়ারি’২২, মঙ্গলবার ভোর ৫টা। চলনবিলের সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পথিকৃত বর্ষীয়ান সাংবাদিক অধ্যাপক আতহার হোসেন (৭৫) চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সাংবাদিক আতহার হোসেন ‘গুরু’ নামেই নাটোর জেলা তথা চলনবিলের সাংবাদিক জগতসহ সর্ব শ্রেণির মানুষের কাছে সমধিক পরিচিত। তাঁর পরিচয়, তিনি একের ভিতরে অনেক। তিনি ছিলেন একেধারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মী এ্বং সাংস্কৃতিক কর্মী। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলের একজন খ্যাতিমান সংবাদ কর্মী।
অধ্যাপক আতহার হোসেন ১৯৭৮ সালের ১ জুলাই বৃহত্তর চলনবিলের কিছু উৎসাহী সমমনা সাংবাদিকদের নিয়ে চলনবিলের প্রানকেন্দ্র গুরুদাসপুরে প্রতিষ্ঠা করেন “চলনবিল প্রেসক্লাব” । তিনি ছিলেন চলনবিল প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক ছিলেন শহিদুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠাতা অন্যান্য সদস্য ছিলেন-অধ্যাপক নজিবর রহমান আব্বাসী ( প্রয়াত), তাড়াশের কাজি মাওলানা রুহুল আমিন মাষ্টার ( প্রয়াত), বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান সাজ্ ু, আব্দুর রাজ্জাক রাজু, আবু সাইদ, চাটমোহরের আব্দুল হামিদ মাষ্টার ( প্রয়াত), আব্দুল মান্নান ( পলাশ), গুরুদাসুপুরের অধ্যাপক শামসুর রহমান, জাকির হোসেন এবং দিলরুবা ওরফে ডলি। প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন অধ্যাপক এম এ হামিদ টি কে। ১৯৭৮ সালে চলনবিল প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৯০ সাল , ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল এবং ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল মেয়াদে কৃতিত্তের সাথে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমার জানা মতে আতহার হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালেই রাজশাহীর আবুল হোসেন মালেকের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক সোনারদেশ পত্রিকায় অনিয়মিত সাহিত্য প্রবন্ধ ও কবিতা লেখার মাধ্যমে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে দৈনিক দেশ এবং দৈনিক গনকন্ঠ পত্রিকায় নিয়মিত সাংবাদিক হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর আর তিনি সাংবাদিকতায় থেমে যান নাই। বিরিতিহীনভাবে তাঁর সাংবাদিকতা পেশাকে গুরুত্বপুর্ন দায়িত্ব হিসেবে পালন করেছেন। সাংবাদিকতার শুরু থেকে ১১ জানুয়ারি/২২ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আতহার হোসেন দৈনিক দেশ, দৈনিক গনকন্ঠ, সাপ্তাহিক প্রকাশ, দৈনিক করতোয়া, দৈনিক আজকালের খবর এবং দৈনিক নয়াদিগন্ত সহ বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানিয় পত্রিকায় লিখতেন।
এছাড়া তিনি দৈনিক দিবারাত্রী পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। বয়সের ভারের কাছে তিনি কখনো সাংবাদিকতা পেশাগত দায়িত্ব পালনে হার মানেন নাই। সংবাদ সংগ্রহে এবং পত্রিকায় সংবাদ পাঠানোতে সবসময় নিষ্ঠাবান ছিলেন এবং সবচেয়ে জরুরী মনে করতেন। এব্যাপারে কখনও ক্লান্ত হতে দেখিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক সাংবাদিক শিষ্য তৈরী করে নাটোর জেলা তথা চলনবিলের সাংবাদিকতা জগতে “গুরু” উপাধির খ্যাতি অর্জন করেছেন। আতহার হোসেন ছিলেন চলনবিলের সাংবাদিকতা জগতের অত্যন্ত সৃজনশীল ও মননশীল উন্নয়ন ভাবনার আলোকিত ব্যক্তিত্ত্ব। তিনি ছিলেন নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের পথিকৃত। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও বর্ষীয়ান এই লৌহ মানব সাংবাদিক আতহারের সাথে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নতুন প্রজন্ম কখনই পিছনে ফেলতে পারে নাই। তাঁর সাথ ধরতে অনেকেই হাঁপিয়ে উঠেছে অথবা সাংবাদিকতা জগত থেকে ছিটকে হারিয়ে গেছে দেখেছি ।
অধ্যাপক আতহার ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল শিক্ষা ও সাংস্কৃতিকবিদ। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শিক্ষা জীবন শেষ করে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সে সময় তিনি যাত্রা , নাটক এবং সঙ্গীত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। পরিবারের সাথে তার কোন যোগাযোগ থাকতোনা। এ সময়ে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। এতে ব্যবসায়ি পিতা সঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরিবারের একমাত্র বড় ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় সবার একটা উচ্চাশা ছিল সংসারের সুনাম বয়ে আনবে। আতহারের পিতা মরহুম আসকান আলী প্রামানিক ছিলেন একজন নামকরা ব্যবসায়ী। অনেক চেষ্টার পর পরিবারের চাপে পিতার ব্যবসায় সহযোগিতায় মন দেন। আতহার প্রতিভাবান ছাত্র হওয়ায় অধ্যাপক আব্দুল হামিদ তাকে খুব স্নেহ করতেন। শিক্ষা শেষে আতহারের বেকারত্ব আবস্থা দেখে শিক্ষাবিদ এম এ হামিদ তাকে নওগাঁ মহকুমা সদরে কালেক্টরিয়েট কে জি স্কুলের অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। কে জি স্কুলের দায়িত্ব নিয়ে কৃতিত্বের সাথে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান। এতে মহকুমা প্রশাসকসহ অভিভাবকদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সুনাম অর্জন করেন। আতহার সবসময় স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। তিনি সবসময় স্বাধীন ও মুক্ত জীবন বেছে নিতেন শত বাধা উপেক্ষা করে। বাউন্ডুলে মন তাকে সেখানেও আটকিয়ে রাখতে পারে নাই। কে জি স্কুলের ব্যবস্থপনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কঠোর নিয়ম চালু করায় অভিভাবক এবং ব্যবস্থপনা কমিটির সাথে মতবিরোধের কারণে কে জি স্কুলের অধ্যক্ষ্যের চাকরি ছেড়ে দেন। নওগাঁর কে জি স্কুল থেকেই তার শিক্ষকতার শুরু।
নওগাঁ থেকে ফিরে এসে আবারো যাত্রা নাটক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অতিরিক্ত মাদকাসক্ত হওয়ায় তার ভবিষ্যত নিয়ে পরিবারে অশান্তি নেমে আসে। এর মধ্যেই অধ্যাপক এম এ হামিদের উৎসাহে সংবাদপ্ত্রে লেখলেখিতে জড়িয়ে পড়েন। এম এ হামিদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলনবিলের সাংবাদিকদের নিয়ে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “ চলনবিল প্রেসক্লাব”।
১৯৮৫ সালে চাঁচকৈড় খলিফা পাড়া নিজ গ্রামে ধর্মীয় শিক্ষানুরাগিদের সাথে নিয়ে তৎকালীন গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেজাউল করিম তরফদারের নামে “রেজাউল করিম দাখিল মাদরাসা“ প্রতিষ্ঠা করেন। আতহারের নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত এই মাদরাসায় এলাকাবাসী এবং ইউ এন ও রেজাউল করিম তরফদারের অনুরোধে সহ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আবারও শিক্ষকতা শুরু করেন।
১৯৮৭ সালে স্যাপ বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর এম মোজাম্মেল হক-র আর্থিক সহযোগিতায় “ খুবজিপুর মোজাম্মেল হক কলেজ “ প্রতিষ্ঠা কাজেও আতহারের সক্রিয় অংশগ্রহন আছে। মাদরাসায় বেতন না থাকায় আমি খুবজিপুর কলেজে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেই। কিন্তু তার কিছু দুর্বলতার কারনে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ এম এ হামিদকে বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। আমি তার হয়ে মোজাম্মেল হক এবং আব্দুল হামিদকে প্রভাষক পদে আতহারকে কলেজে নিয়োগের অনুরোধ করলে শর্তসাপেক্ষে নিয়োগ দেন। কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেছেন। ২০১২ সালে চাকুরি জীবনের অবসান ঘটিয়ে অবসর গ্রহন করেন।
আতহার হোসেন আজীবন নিজেকে স্বার্থহীন ভাবে উৎসর্গ করেছেন সামাজিক উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়। ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব সুনামের সাথে পালন করে আসছেন।
অধ্যাপক আতহার হোসেনের মৃত্যুতে চলনবিল তথা গুরুদাসপুরের সাংবাদিকতা জগতে বিশাল শুন্যতার সৃষ্টি হল। মৃত্যু কালে তিন স্ত্রী, ৬ পুত্র এবং ৫ কন্যা সন্তান , নাতি- নাতনিসহ হাজারো গুনগ্রাহী স্বজন এবং শিষ্য রেখে গেছন। আল্লাহ তাঁকে বেহেস্তবাসী করুন। আমিন।