২০ ডিসেম্বর ২০১৯, শুক্রবার দিবাগত রাতে আমার বাবা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তখন আমি একটি গোপনীয় কাজে ঢাকা সেনানিবাসে ছিলাম। আমার পরিবারের সবাই ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ ক্যম্পাসে ছিল। খবর পেয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা শেরপুরে ছুটে যাই। বিদেশ থেকে দুই ভাই ফিরতে পারেননি। ২১ তারিখ দুপুরে শেরপুর পৌর পার্কে বাবার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আমরা লাশ নিয়ে গাঁয়ের বাড়ি বলিদাপাড়ায় যাই। সেখানে আসরের পর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
শেরপুর যাওয়ার পর পুরো সময় আমার দশ বছর বয়সী পুত্র তাসনীফ আমার সঙ্গে ছিল। সে জীবনে প্রথম একজন প্রিয় মানুষকে হারিয়ে খুব কষ্ট পায়। সারাদিন তার মুখে কোন হাসি ছিল না। গাঁয়ের বাড়ি গিয়ে বাবার কবর খনন দেখে সে আরও মর্মাহত হয়। তার এই ঘোর কাটানোর জন্য আমি আমার শিশুকালের গাঁয়ের বাড়ির বর্ণনা দেই। ওকে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের গায়ে গায়ে লাগালাগি অসংখ্য ঘর-বাড়ি দেখিয়ে বলি, তখন এসব একটি বাড়িও ছিল না। চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ ছিল। এই মাঠে আমরা সারাদিন খেলেছি। ঘুড়ি উড়িয়েছি।
তাসনীফ আমার কথা শুনে বিশ্বাস করতে পারে না। সে বিষ্ফারিত চোখে তাকায়। আমি বলি, আর যেখানে তোমার দাদার জানাজা হবে এটা বেশ নামা-জমি ছিল। এখানে বর্ষাকালে অনেক পানি হতো। সেখানে সারাদিন সাঁতার কেটেছি। ভেলা বানিয়ে অনেক দূর ভেসে গিয়েছি। মাছ ধরেছি। কী যে মজা করেছি!
তাসনীফের মুখে তবুও হাসি দেখিনি। এরপর সে ঝিনাইদহ ফিরে গিয়ে আমার গাঁয়ের বাড়ি সম্পর্কে নানান প্রশ্ন করেছে। আমি এতো বিশাল মাঠে খেলেছি এটা তার কাছে অবিশ্বাস্য। তখন ক্রিকেট খেলা ছিল না। ফুটবল কেনার সামর্থ ছিল না। জাম্বুরা অথবা খড় দিয়ে বল বানিয়ে ফুটবল খেলেছি। ডাংগুলি, দাড়িয়াবাঁধা, গোল্লাছুট, কানামাছি ও কাবাডি খেলেছি। লাঠি খেলার কসরৎ করেছি। জোসনা রাতে লুকোচুরি ও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলেছি।
তখন খেলার অনেক মাঠ ও সুযোগ থাকলেও খেলুড়ে কম ছিল। এখন ঘরে ঘরে খেলুড়ে। খেলার মাঠ অপ্রতুল। এখন শিশুরা খেলার মাঠের অভাবে ঘরের বারান্দায় ক্রিকেট খেলে। যারা সেই বারান্দায় খেলারও সুযোগ না পায় তারা মোবাইল অথবা ল্যাপটপে গেইম খেলে। এসব অনেক ভিডিও গেইম আছে। অন-লাইনেও কয়েকজন মিলে গেইম খেলা যায়। আগে আমি নিজেও মাঝে মাঝে মোবাইলে ও ল্যাপটপে গেইম খেলেছি। তবে তাতে আমার কোন নেশা বা আসক্তি ছিল না।
বর্তমানে খেলার ধারা পালটেছে। কিছু কিছু খেলা নিয়ে বেশ সমালোচনা শুনেছি। তন্মধ্যে একটি PUBG (পাবজি) এবং অপরটি Free Fire (ফ্রি ফায়ার). এ দুটো সম্পর্কে সমালোচনা শুনলেও কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু গত দু-তিন দিন আগে আমার একজন ফেইসবুক বন্ধু এই সম্পর্কে কিছু লেখার অনুরোধ করেন। তার অনুরোধে প্রথমত নিজে এই সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। এরপর একজন সহকর্মীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই রসিকতা করে উত্তর দিলেন, পাপীরা PUBG (পাবজি) খেলে। তাই এর নাম ‘পাপজি’ হওয়া উচিত ছিল। তবে আমার চেয়ে আপনাকে ‘উনি’ ভালো ধারণা দিতে পারবেন।
এই ‘উনি’ও আমার একজন অনুজ সহকর্মী। তার কাছে এই বিষয়ে জানতে চাই। সেই সহকর্মী এ বিষয়ে আমাকে স্যমক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, স্যার, যে কোন খেলায় আসক্তি জন্মানো খুব স্বাভাবিক। আর যে কোনও আসক্তিই ক্ষতিকর এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মারাত্মক। চীন অনেক আগেই PUBG (পাবজি) খেলাটি নিষিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে এই খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কারণ এই খেলা বন্ধ করার জন্য তাগিদ দেওয়ায় একজন আত্মহত্যা করেছে। বেশ কিছু পরিবারের অশান্তি এমন পর্যায়ে গেছে যে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটেছে। পাবজি গেইমটি ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা-পড়া বিমুখ করেছে।
ভদ্রলোক স্বল্পেই কেন যেন হাঁপিয়ে উঠেন। তিনি বলেন, পাবজি একটি ব্যবসা সফল ভিডিও গেইম। এটি বাজারে আসার পর থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করেছে। PUBG (পাবজি)-এর পূর্ণরূপ হলো Player Unknown’s Battle Grounds. প্রতিদিন কয়েক কোটি মানুষ এই গেইমটি খেলে। এটি শিশু-যুবক-বুড়ো সবার কাছেই সমান জনপ্রিয়। এই খেলা জনপ্রিয় হলেও মানুষের মধ্যে হিংস্র, আগ্রাসী ও সহিংস মনোভাব তৈরি করছে। তাছাড়া শুধু কোন ভিডিও গেইম জীবনের মহা মূল্যবান কালক্ষেপনের অনুসঙ্গ হতে পারে না।
সহকর্মী বলেন, অনেকে এই খেলার সঙ্গে টাকা-পয়সার লেন-দেন করে জুয়ায় রূপান্তর করেছে। এই খেলা একবার শেষ হতে ত্রিশ মিনিটের মতো সময় লাগে। খেলা শুরুর পর সময় কিভাবে কেটে যায় বোঝা দায়। অনেকে সারারাত খেলে। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই খেলাটি সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই খেলায় আসক্ত শিশুদের মধ্যে খুবই আক্রমণাত্বক আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া এই গেইম সকলের মানসিক বিকৃতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এসবই অপুরনীয় ক্ষতির কারণ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
ভদ্রলোক বললেন, এই খেলা বেশ কয়েকজন মিলে অন-লাইনে খেলা যায়। তবে চারজন মিলে খেললে ভালো হয়। এখানে টিকে থাকার উপর স্কোর গণনা করা হয় এবং বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এই খেলায় সবচেয়ে খারাপ দিক হলো হত্যাকাণ্ড। টিকে থাকার লড়াইয়ে একজন আরেকজনকে হত্যা করতে হয়। যে টিকে থাকে তাকে বীরের সম্মান দেওয়া হয়। একজন হত্যাকারী বীরের সম্মান পেতে পারে না। আর এক সময় ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা ছিল। এখন তা জুয়াড়িদের পাল্লায় পড়ে ওর স্বকীয়তা হারিয়েছে। PUBG (পাবজি) গেইমটিও এখন একক খেলায় সীমাবদ্ধ নেই। এটা যৌথ খেলায় এক প্রকার জুয়ার পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি থেমে দম নিয়ে বলেন, এই খেলায় বিমানের সাহায্যে একশত প্রতিযোগী নিয়ে একটি দ্বীপে বা পরিত্যক্ত শহরে ছেড়ে দেওয়া হয়। পঁচিশটি বিমানের প্রতি বিমানে চারজনের একটি দল থাকে। তারা প্যারাস্যূটের মাধ্যমে সে দ্বীপে নিরস্ত্র অবস্থায় নামে। সে দ্বীপে অনেক প্রাচীন ও পরিত্যাক্ত বাড়ি-ঘর থাকে। তার বিভিন্ন স্থানে মারণাস্ত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বা লুকানো থাকে। প্রথমত সেসব অস্ত্র খুঁজে বের করতে হয়। তারপর পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। সেই মারণাস্ত্র ব্যবহার করে একজন আরেকজনকে হত্যা করে। সেখানে মরণ-পণ লড়াইয়ে বর্বরোচিত হামলা ও আদিম উম্মাদনা বিরাজ করে।
ভদ্রলোক বেশ হয়রাণ হয়ে উঠেন। সশব্দে ঢোক গিলে বলেন, স্যার। জাপানীরা নাকি একটি সিনেমা তৈরি করেছে। আমি দেখিনি। নামও জানি না। সেই সিনেমার মূল উপজীব্য হলো বিয়াল্লিশজন শিক্ষার্থীকে একটি নির্জন দ্বীপে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর তাদের পরস্পরকে হত্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। সত্যই মারাত্মক ক্ষতিকারক সেই সিনেমা এবং এই গেইম। যে কোন মূল্যে এই খেলাটি আমাদের দেশেও নিষিদ্ধ করা অতিব জরুরি। নইলে এদেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ হওয়ার পাশাপাশি আমাদের সমাজেও অমানবিক সহিংসতা ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
ভদ্রলোক পানি খেলেন। তারপর বলেন, স্যার, এই গেইমটি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মতো বিষয়ও রয়েছে। আমাদের উত্তর প্রজন্ম ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি উদাসীন এবং অনেকটা ধর্মবিমুখ। সবচেয়ে বড় কথা হলো ইসলাম কখনওই সন্ত্রাস, সহিংসতা ও নিরাপরাধীকে হত্যার সমর্থন করে না। কিন্তু কোন কোন ভিডিও গেইমের এসব বিষয়ই মূল উপজীব্য।
ভদ্রলোক আবারও সশব্দে ঢোক গিলে বলেন, প্রাচীন রাজা-বাদশাদের কথা শুনেছি। কিছু কিছু ভিডিও গেইম তাজা রক্ত পিপাসু প্রাচীন রাজা-বাদশাদের দাবা খেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। তারা নাকি দাবা খেলায় বীর ও কুশলী সৈন্যদের ব্যবহার করতো। তারা সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়ে আমৃত্যু লড়াই করতো। খেলার ছলে সৈন্যদের তাজা রক্ত দেখে রাজা-বাদশারা খুশি হতো। প্রাকারান্তরে আমাদের শিশুদেরও সেসব শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি! তবে এ কথাও সত্য যে যেসব ভিডিও গেইম জনপ্রিয়তার শীর্ষে তার প্রতিটিই এমন হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা নির্ভর।
ভদ্রলোক থামেন। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবি। প্রায় তিন যুগ আগে আমেরিকার শিশুদের অমানবিক আচরণের কারণ নিয়ে একটি গবেষণার নিবন্ধ পড়েছিলাম। সেখানে যতো কারণ উল্লেখ করা হয়েছিল তন্মধ্যে টিভিতে সম্প্রচারিত কার্টুনকে দোষারোপ করা হয়েছিল। সে দেশের টিভিতে সম্প্রচারিতচারিত প্রায় প্রতিটি কার্টুন সিনেমায় যুদ্ধ-বিগ্রহ-হত্যাযজ্ঞ-ধ্বংসলীলা দেখানো হতো। কোমলমতি শিশুদের উপর এর দারুণ প্রভাব পড়ে। ফলে তারা সেই শিশুকালেই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। ওদের ভিতরের মানবিক গুণাবলী ক্রমে লোপ পায়। গবেষকগণ এসব কার্টুন টিভিতে সম্প্রচার বন্ধের সুপারিশ করেছিলেন।
গত ১৫ মার্চ, ২০১৯ শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল-নূর মসজিদে যে হামলা হয় সেটা সে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ছিল। সেই হামলায় আমাদের জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটারকে আল্লাহ্ হেফাযত করলেও পঞ্চাশজন মুসুল্লী মারা যান এবং পঞ্চাশ জনের মতো আহত হোন। সেই মসজিদে হামলাকারী ব্র্রেন্টন ট্যারেন্ট নাকি এই ধরনের অন-লাইন গেইম খেলায় আসক্ত ছিল এবং সে অনুযায়ি হামলা ও হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কী অকল্পনীয় ও অবিসম্ভাবী পরিণতি!
এরপর আমার একজন ক্যাডেটের সঙ্গে মোবাইলে এই প্রসঙ্গে কথা বলি। তার কাছে এই খেলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। সে প্রথমেই অকপটে স্বীকার করে যে সে এই খেলা মাঝে মাঝে খেলে। তবে এতে তার আসক্তি নেই। তাদের অধিকাংশই এসব খেলায় সময় নষ্ট করে। অনেকে নেশাগ্রস্থ এবং এটা ওদের জন্য ক্ষতিকর বলে সে স্বীকার করে। তাকে আমি সেই ভিডিও গেইম-এর উপর্যুক্ত সকল বিষয় বর্ণনা করে শোনাই। সে সবই সঠিক বলে জানায়।
এরপর সেই ক্যাডেট একটি কথা বলার জন্য ইতস্তত করে। আমি অভয় দিলে বলে, স্যার, আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের ছোট্ট এক ছেলে এই খেলায় মাত্রাধিক আসক্ত। সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। খেলা শুরুর পর খুব দ্রুত প্রতিযোগীরা মারা গেলে সে সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার এক কাকাতো ভাই কলেজে পড়ে। সে এই খেলায় আসক্ত। সে ঘুমের ঘোরে চমকে উঠে। কারণ সে নাকি দেখে তার শত্রুরা তার দিকে তেড়ে আসছে। সে রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারে না। স্যার, আসলে এসব ভিডিও গেইমে ভালো কিছু শেখার নেই। আমরা দিন দিন মন্দ কিছু দ্বারা তাড়িত হচ্ছি।
ওকে আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি যেসব গেইম খেলে খুব মজা পেয়েছো এবং নিছক আনন্দই যার উপজীব্য এমন কোন ভিডিও গেইমের নাম বলবে কী!
সে এবার খুশি হয়ে বলে, জ্বি স্যার। আমরা দুই ভাই মিলে একটি খেলায় খুব মজা পাই। ওর নাম FIFA (ফিফা). এটি একটি ফুটবল গেইম। খুব ভালো লাগে স্যার। আমরা দুই ভাই দুটো দলের নিয়ন্ত্রণ করি এবং জয়-পরাজয় মেনে নিই। আরও একটি খেলায় মজা পাই। ওর নাম Need for Speed (নিড ফর স্পিড). এই ভিডিও গেইমটি মূলত গাড়ি চালনার প্রতিযোগিতা। এই খেলাটি একা একা খেলেছি স্যার। ভালো লেগেছে।
এতো এতো তথ্য দেওয়ায় ক্যাডেটকে ধনবাদ জানাই। FIFA (ফিফা) গেইম সম্পর্কে সামান্য পূর্ব ধারণা থাকলেও Need for Speed (নিড ফর স্পিড) সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না। সে আমাকে কিছুটা হলেও তথ্য দিয়েছে। পরিশেষে সে আবারও অকপটে স্বীকার করেছে যে PUBG (পাবজি) আসলেই আমাদের দেহ-মন ও মননে খুব বাজে প্রভাব ফেলছে।
আমার লেখার শুরু দিয়ে শেষ করি। শুরুতেই আমার গাঁয়ের বাড়ির অবারিত ও উম্মুক্ত মাঠের কথা উল্লেখ করেছি। তখন খেলার উপকরণ না থাকলেও দিনমান খেলেছি। রোদে পুড়েছি। বৃষ্টিতে ভিজেছি। গায়ে ধুলো কাদা মেখে খালে বা পুকুরে সাঁতার কেটেছি। গাছের শাখায় উঠে আম-জাম পাড়ার প্রতিযোগিতা করেছি। আমাদের শারীরিক সক্ষমতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, সহনশীলতা বা কষ্টসহিষ্ণুতা বর্তমান যুগের শিশুদের নেই। আমরা খেলার সাথীদের সঙ্গে সন্ধ্যায় মারামারি করেছি আবার সকালে গলাগলি করেছি। রাতের নিরবিচ্ছিন্ন গভীর ঘুম আমাদের মন-মানসিকতাকে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ভুলিয়ে দিয়েছে।
আমরা বয়োজ্যেষ্ঠ মানেই মুরুব্বী মেনেছি। তিনি আপন না পর সে কথা ভাবিনি। মুরব্বীদের ধমক বা পিটুনি আমাদের কখনও অভিমানী করেনি। বরঞ্চ তাঁদের শাসনকে আমরা সমীহ করেছি এবং শিক্ষা মনে করেছি। কিন্তু বর্তমান যুগের শিশুরা বড্ড অসহিষ্ণু ও অভিমানী। তাদের পিটুনি দূরের কথা চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলাও দায়। কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য কারণে বাবা-মা’র উপর অভিমান করে অনেকে আত্মহত্যা করে। আবার কখনও বা মুরুব্বীজনকেই হত্যা করে। এই অমানবিক আচরণের মূলে কি! সেসব ভিডিও গেইম নয় কি!
বর্তমানে খেলার অসংখ্য ও সহজলভ্য উপকরণ রয়েছে। কিন্তু খেলার মাঠ নেই। তাসনীফ খেলা পাগল প্রায় দশ বছরের এক শিশু। সে মোবাইল গেইমও পছন্দ করে। কিন্তু আমি তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিতে সমর্থ হয়েছি। ল্যাপটপে সে “পেইন্ট অপশন”-এ আঁকিবুঁকি শিখে। এসব শেখার জন্য আমিই তাগিদ দিই। সে টিভিতে মীনা ও ঠাকুরমার ঝুলি ইত্যাদি কার্টুন দেখলেও সীমা অতিক্রম করে না। তাছাড়া বিভিন্ন ব্লক ব্যবহার করে নানাবিধ জিনিস তৈরি করে। তবে সুযোগ পেলেই সে বাইরে খেলতে যায়। আমি এতে কখনওই বাধা দেই না। বরঞ্চ ঘরের ভিতরের খেলার চাইতে বাইরের খেলায় বেশি উৎসাহ দেই।
আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, মান-অভিমান, সহিংস ও অমানবিক আচরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। মানুষ নিত্য নতুন ও অভাবনীয় প্রতারণার জাল বিস্তার করতে শিখেছে। ছদ্মবেশী মানুষের অনাচার দেখে প্রতিনিয়তই আমরা বিষ্ময়াভিভূত হচ্ছি। এখন যদি আমাদের উত্তর প্রজন্মও এসব বিতর্কিত গেইম খেলে অমানবিক আচরণ শিখে এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
তাই আসুন আমরা সবাই সতর্ক হই। আমাদের সন্তানদের শাসনের সঙ্গে স্নেহ করি। আমরা ওদের কথায় না চলে ওদেরকে আমাদের কথায় উঠা-বসা শেখাই। ওদের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে ক্রিকেট ব্যাট তুলে দেই। ওদের মাঠে অথবা ঘরের বারান্দায় ফুটবল খেলার সুযোগ করে দিয়ে টিভি থেকে দূরে টেনে নেই। ওদের ব্লক ব্যবহার করে বিভিন্ন জিনিস তৈরির সুযোগ দিয়ে, ছবি আঁকার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম অথবা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র হাতে তুলে দিয়ে ল্যাপটপটা কোল থেকে কেড়ে নেই। ওদেরকে একমুখী চিন্তা-চেতনার বাইরে টেনে নিয়ে ওদের বহুমুখী প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেই এবং ওদের সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলি।
আর সবচেয়ে ভালো হবে যদি সন্তানকে বই পড়ার নেশা ধরানো যায়। দুনিয়ার সামগ্রিক ক্ষতি থেকে বাঁচানোর সবচেয়ে ভালো পথ হলো ভালো বই পড়ায় নেশাগ্রস্থ করে সন্তানকে গড়ে তোলা। এতে তার জ্ঞানচক্ষু উম্মুক্ত হবে। অন্তরে জ্ঞান পিপাসা জাগ্রত হবে। ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-বিজ্ঞান-ইতিহাস তার মাঝে মানবিক গুণাবলীর সকল দুয়ার খুলে দিবে। সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে পুনর্জন্মলাভ করবে। দেশ ও দশের সেবা করবে এবং এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।
ধন্যবাদ সবাইকে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ।