নাটোরে লক ডাউন চলছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান ছাড়া সবই বন্ধ। কাল খুব ভোরে আমাদের পরিচিত আক্কাস চাচা ফোন দেন আমার বরকে। একটা মোবাইল ফোন কিনতে চান তিনি। খুব দরকার ওনার। কিন্তু দোকান তো বন্ধ। কোন উপায়ে কি একটা ফোন কেনা যাবে? ১৮০০০ থেকে ২০০০০ টাকার মধ্যে একটা ফোন কিনতে চান চাচা।
চাচার সাথে কথা বলা শেষে আমার বর আমাকে বলে দেখছো মানুষের অবস্থা পরিবর্তন হতে সময় লাগে না। আগে আক্কাস চাচার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো ছিলো না, কিন্তু এখন উনার অবস্থা দেখছি ভালো হয়েছে এতো টাকা দিয়ে ফোন কিনতে চাচ্ছে। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু উনি সকাল দশটার দিকে গ্রাম থেকে ছেলেকে সাথে নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। এবং উনার এই ফোন কেনা কেন এতো জরুরি তা শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি।
আক্কাস চাচার ছেলে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র নয়ন। যেহেতু অনেক দিন ধরে কলেজ বন্ধ তাই পড়াশোনা একপ্রকার বন্ধ-ই বলা চলে। গত বছর করোনা শুরু হওয়ার পরে ছেলের চাপে পড়ে একটা দামী স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছেন। তখন অনলাইনে পড়াশোনার কথা বলেও পরে চাচা খেয়াল করেন সারা রাত দিন ফোনে গেইম খেলায় ছেলের একমাত্র কাজ। গেইম খেলার মাত্রা এতোটাই ছিলো যে খাওয়া দাওয়ারও খেয়াল থাকে না। তাছাড়া এমবি কেনার টাকার আবদার তো লেগেই থাকে। অনেক ভাবে বাধা দিয়েও গেইম খেলা থেকে ফিরানো যায়নি। পরশুদিন কথা কাটা কাটির একপর্যায়ে চাচা ছেলের ফোনটা ভেঙ্গে ফেলেন। আর এতেই ছেলের মরণদশা। ছেলের এক বার আত্মহত্যা করতে যায় তো আরেক বার বাব মা কে মারতে যায়। মোবাইলের শোকে ছেলে ভাত পানি ছেড়ে দিয়েছে। ছেলের বক্তব্য আমার একটা হাত কেটে নেও কিন্তু আমার মোবাইল ফোন দিয়ে দাও।
ছেলের এমন পাগল প্রায় অবস্থা দেখে চাচী ও ছেলের পক্ষে অবস্থা নিয়েছে। চাচীর বক্তব্য খেলুক গেইম তবু আমার ছেলে বেঁচে থাকুক। আর ছোট মানুষ যাবেই বা কোথায় স্কুল কলেজ সব বন্ধ, সময় কাটানোর জন্য তো একটা কিছু করা চাই? নয়ন আর চাচীর চাপে পড়ে গ্রামের একজনে কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা ধার করে চাচা মোবাইল কিনতে বের হয়েছে। ছেলের জীবন বলে কথা!
আমাদের আসে পাশে নয়নদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। হয়তো ভালোভাবে খোঁজ করলে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন নয়নের দেখা পাওয়া যাবে। যে কিনা মোবাইলে জন্য নিজের জীবন দিতে পারে এবং অনেক নয়নরা এই মোবাইল গেইমের নেশায় পড়ে কখনো নিজে আবার কখনো বাবা মার জীবন নিতে পিছ পা হচ্ছে না। এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানরা কিন্তু কেন এই এটা ঠিক সারা পৃথিবী এখন একটা অস্থির সময়ে পার করছে। আমরাও পার করছি। প্রায় দেড় বছর ধরে বাচ্চাদের পড়াশোনা কার্যত বন্ধ প্রায়। এবং আমরা সবাই একপ্রকার গৃহবন্দী। আমাদের দৈনন্দিন কাজে, অভাসে এসে অনেক পরিবর্তন। আমরা বড়রা মানিয়ে নিতে পারলেও আমাদের বাচ্চাদের পক্ষে অনেকটাই কষ্টকর। তার মানে কি আমরা সময় কাটানোর নামে মোবাইল আসক্তি মেনে নিবো? চোখের সামনে আমাদের বাচ্চাগুলো দিন দিন মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু কেন এই অবক্ষয়? এ দোষ কি শুধু আমাদের সন্তানের? না তাদের এই অবক্ষয়ের জন্য আমরাও সমান দায়ী। আমরা আমাদের দায় এড়াতে পারিনা। কারন আজ যখন বাচ্চারা মোবাইল হাতে নিচ্ছে সময় কাটানোর কথা বলে।বন্ধু হিসেবে মোবাইল তাদের সঙ্গী। তখন একবার ভাবুন তো আমরা কি তাদের ছোট থেকে কখনো বই বন্ধুর সাথে পরিচয় করে দিয়েছি কি না? নিজে কখনো তাদের বন্ধু হবার চেষ্টা করেছি কি না? পাঠ্য বইয়ের বাহিরে আমরা অনেকেই বাচ্চাদের বই পড়তে দিইনি। যদিও আমরা সবাই জানি বই সব সময়ের জন্য ভালো বন্ধুর ভূমিকা পালন করে।