আজকাল আর পয়সা খরচ কর্যা কেউ বানর খেলা দ্যাখে না রে বাপু! বুড়ারা তো দ্যাখেই না, ছাওয়াল-পাওয়ালরাও না! মুনে হয় মজা পায় না রে! পাবি কি কর্যা! বানর খেলাত্ তো আর রঙ-ঢং নাই! তোর এই পাখির খাঁচার মত বুড়া শরীরেত কি আর রস আছে রে! কী দেখাবু তুই? তুই কি আর শাবনূরের মতন শরীর নাচাইতে পারবু? না ময়ূরীর মতন কোমর ঝাঁকাইতে পারবু রে রাজা! মানষে এখন ইউটুবে ডাগর ডাগর ছুঁড়ি-পুড়ির আউলা বাউলা নাচ দ্যাখে। রাতভর মোবাইলে পিরিতের কতা কয়! আর ছাওয়ালপাওয়াল কম্পুটারে গেম খেলে। কী সব ঢিসুম ঢিসুম খেলা বাইর হসে!
রমিজ শিকলে বাঁধা বুড়ো বানরটার সাথে প্যাচাল পাড়তে পাড়তে একটা ভাঙা দেয়ালের ওপর বসে। হাতের কৌশলে শিকলে টান দিলে কলের পুতুলের মত বানরটাও বসে পড়ে মাটিতে। সকাল থেকে শহরের অলি-গলি ঘুরে ঘুরে একটা মজমাও বসাতে পারেনি সে। ক্ষিদেই পেট জ্বলে যাচ্ছে। সেই সাত সকালে একমুঠ পান্তা রাহেলার সাথে ভাগাভাগি করে খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। তারপর দুই ক্রোশ রাস্তা হেঁটে এসেছে শহরে।
বুড়ো বানরটার পেটে তো কিছুই দিতে পারেনি। একটা অন্তত মজমা বসাতে পারলেও বোনরুটি কিনে দিতে পারতো। অবলা জানোয়ার! মুখে তো কিছু বলতে পারে না। নিজের পেটটাকে না হয় বশ মানাতে শিখেছে কিন্তু অবলা জানোয়ারটাকে কীভাবে বোঝাবে সে!
একটু জিরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় রমিজ। বসে থাকলে তো চলবে না। কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। হাঁটতে হাঁটতে মহল্লার গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। কাঁপাকাঁপা হাতে ডুগডুগিটা চেপে ধরে। অভ্যস্ত হাতের নিপুণ কৌশলে বাজাতে শুরু করে সেটা। ভেতর থেকে সজোরে হাঁক দেয়, দেখবেন বানর খেলা…।
চৈত্রের সূর্য তখন তির্যক রশ্মি ছড়াচ্ছে। দড়দড়িয়ে ঘামছে রমিজ। পাশে তাকিয়ে দেখে বুড়ো বানরটারও জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। পাঁজরা বেরিয়ে পড়া বুকের হাঁপরটা উঠানামা করছে। ডুগডুগি কেঁচিয়ে ধরে আরো কয়েকবার হাঁক দেয় রমিজ, দেখবেন বানর খেলা….!
আসেপাশে তাকায়। গুটি কয় ছেলেপুলে এসে জড়ো হয়। রমিজ বোঝে এ দিয়ে খুব বেশি রোজগার হবে না। তবু বওনি বলে কথা! শুরু করে দেয়। ঘুরে ঘুরে অদৃশ্য একটা বৃত্ত এঁকে দিলে ছেলেপুলেরা গোল হয়ে দাঁড়ায়। রমিজ আরো কিছুক্ষণ ডুগডুগি বাজিয়ে মজমা জমানোর চেষ্টা করে। না, এর বেশি আর জমবে না। শুরু হয়ে যায় খেলা। অভ্যস্ত নির্দেশনা পেয়ে বুড়ো বানর একে একে খেলাগুলো দেখিয়ে চলে। খেলা শেষ হলে রাজা পয়সা আদায় করতে থাকে।
সারা মজমা ঘুরে পাওয়া গেল মাত্র নয় টাকা। টাকাগুলো গুনে নিয়ে হতাশ দৃষ্টিতে বানরের দিকে তাকায়। রাজাও কিছু একটা বুঝেছে নিশ্চয়! ফ্যাল ফ্যাল করে সেও তাকায় রমিজের দিকে। অবলা হলেও রমিজের সাথে রাজার সখ্যতা দীর্ঘ দিনের। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে সুখে দুখে একাকার হয়ে আছে দু’জনে। রমিজের বাবা তাকে আদর করে রাজা নামে ডাকতো। রমিজও বাবার দেয়া নামের অমর্যাদা করেনি।
সেই কিশোর বয়সে বাবার হাত ধরে বানর খেলা দেখানো শিখেছিল রমিজ। অল্প বয়সেই যশ চলে আসে হাতে। ডুগডুগি বাজিয়ে যখন হাঁক দিত, শত শত মানুষ উপচে ঘিরে উপভোগ করতো তার নিপুণ পরিচালনায় বানর খেলা। গোল হয়ে ঘিরে ধরে করতালিতে মেতে উঠতো আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। পয়সা ছুঁড়ে দিতো বৃষ্টির মত। বৌ-ঝিরা ঘর থেকে কাঠায় করে চাল এনে ঢেলে দিতো তার ঝোলায়। তাই নিজের অজান্তেই পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত পেশায় ঢুকে পড়ে রমিজ।
কিন্তু সময় পাল্টেছে। আজকাল বানর খেলা কেউ দেখতে চায় না। দু-চারজন যদিও বা মজমায় এসে জড়ো হয় পয়সা দেয়ার সময় এলে একে একে কেটে পড়ে। বানর খেলার উপভোগ্যতার চাইতে ঢের বেশি উপভোগ্য উপাদান এখন মানুষের হাতের কাছে চলে এসেছে। মানুষ এখন ঘরে বসে সিনেমা দেখে। টেলিভিশনে নানা রঙের অনুষ্ঠান দেখে। সারাদিন মোবাইল ফোনে কথা বলে। ইন্টারনেটে… ফেসবুকে চ্যাটিং করে ঢের বেশি আনন্দ পায় মানুষ। সারা পৃথিবী যেখানে এখন হাতের মুঠোয় সেখানে বুড়ো এক বানরের একঘেঁয়েমি কেরিকেচার মানুষকে আর দোলা দেয়না।
এসব খুব ভাল করেই বোঝে রমিজ। এটাও বোঝে যে এই পেশা না ছাড়লে না খেয়ে মরতে হবে। বুড়ো বাবাটা বিনা ওষুধে মারা যাবে। যুবতি মেয়েটার কোন সদ্গতিও করতে পারবে না। কিন্তু উপায় কী! সারা জীবনে তো আর কোন পেশার কথা ভাবেনি রমিজ। পেশাটাকে ভালবেসে ফেলেছে সে। শরীরের শিরা-উপশিরায় মিশে গেছে ডুগডুগির ছন্দ আর সেই কালজয়ী হাঁক, দেখবেন বানর খেলা…!
ব্যবসা করার মত টাকাও নাই তার। তাই বুড়ো বানরটাকে নিয়েই ঘুরে বেড়ায়। যা দু’চার টাকা পায় তাই দিয়ে তিনজনের সংসারের ভার বয়ে বেড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে। চাল কেনার পয়সা জোটে তো তরকারি কেনার জোটে না। নিজের জন্য কষ্ট নয়, কষ্ট হয় বৃদ্ধ ওস্তাদতুল্য বাবা, মেয়ে রাহেলা আর তার সন্তানতুল্য বানরটার জন্য। ওরা যখন পেয়াজ মরিচ দিয়ে শুকনো ভাত গলায় ঠুসে পানি দিয়ে গিলে নামানোর চেষ্টা করে কিংবা সারাদিন ঘুরে ঘুরে হেঁটে হেঁটে খেলা দেখিয়ে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত বানরটার মুখে যখন একটা কলা তুলে দিতে হিমসিম খায়; তখন কষ্টে বুকটা ফেটে যায় রমিজের। বানরটাকে প্রচ- ভালবাসে সে। নিজের মুখের রুটির টুকরোটাও তুলে দেয় বানরের মুখে। বুকে জড়িয়ে সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো ভাগাভাগি করে এই প্রশিক্ষিত অবলা জীবটাকে। যেন বানরটাই তার একমাত্র বন্ধু।
মোড়ের স্টলে এসে ছয়টাকা দিয়ে দুইটা বনরুটি কিনে একটা রাজার হাতে তুলে দেয় রমিজ। রাজা ছোঁ দেয়ে হাত থেকে টেনে নেয় সেটা। গো-গ্রাসে গিলতে থাকে। নিমেষেই শেষ করে দেয় পুরোটা। রমিজ বুঝতে পারে কী পরিমাণ ক্ষুধা পেটে নিয়ে এতক্ষণ নির্বিকার খেলা দেখিয়ে গেল রাজা। আদর করে জড়িয়ে ধরে রাজাকে। রাজাও যেন আশ্রয় খুঁজে পায় রমিজের আলিঙ্গনে। রমিজ তার আধখাওয়া বনরুটিটা এগিয়ে দেয় রাজার মুখের দিকে। রাজা কিছুক্ষণ রুটিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সে রমিজের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে রুটিটা সরিয়ে দেয়।
‘খা.. খা! তোর যে পেট ভরেনি আমি তো বুজিসি!’ রমিজের কথায় কিছু একটা ভাবে রাজা। তারপরও সে ফিরিয়ে দেয়। ‘ক্যা রে, আমার তো প্যাট ভরিসে, তুই খানা বাপু!’ রাজা তবুও নেয় না। রমিজ বুঝে যায় রাজাকে আর কিছুতেই খাওয়ানো যাবে না। কেননা রাজা জানে রমিজের পেটেও জ্বলন্ত চিতা। রমিজ আধখাওয়াটা নিজে খায়। বাকি তিনটাকা দিয়ে আরেকটি রুটি কিনে রাজাকে দেয়। রাজা এবার খেতে শুরু করে।
২.
আক্কাসের দোকানের কাছাকাছি আসতেই পা ভারি হয়ে আসে রমিজের। সামনাসামনি হলেই তো বাকির টাকা চাইবে। কী জবাব দেবে? আজ সারাদিনে খরচখরচা বাদে রোজগার হয়েছে আটচল্লিশ টাকা আটআনা। এক কেজি চাল কিনতেই চলে যাবে পঁয়ত্রিশ টাকা। বাকি সাড়ে তেরটাকা দিয়ে তরকারিই বা কিনবে কি দিয়ে? আর ময়মসলাই বা কিনবে কি দিয়ে? রাজার জন্যও তো কিছু কেনা চাই। বেচারা এই বুড়ো বয়সেও যে হারে পরিশ্রম করে যাচ্ছে!
দিনে দিনে আক্কাসের মুদির দোকানে একটা মোটা অংকের দেনা জমে গেছে। আক্কাস মাঝে মঝেই তাগাদা দেয়। শোধ দিতে পারে না রমিজ। দেবেই বা কি করে! প্রতিদিন যা উপায় হয় তা বাঁচলে তো! একদিকে রোজগার কমছে আরেক দিকে হুহু করে জিনিস-পত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সাড়ে তিন হাত মানুষের আড়াই হাত কাপড়! মাথা ঢাকতে গেলে পা উদাম, পা ঢাকতে গেলে মাথা। অনিচ্ছা সত্বেও রমিজ এগিয়ে যায় আক্কাসের দোকানের দিকে।
‘আগের ট্যাকাই শোধ দিচ্চনা রমিজ ভাই, আবার বাকি চাইচ্চ?’ আক্কাসের বাঁকা কথার কী জবাব দেবে বুঝে পায় না রমিজ। চুপ করে থাকে।
‘ক্যারে বাপু, কতা কইচ্চ না ক্যা? ট্যাকা শোধ দিবা কবে?’
রমিজ মিনমিনে গলায় বলে, ‘আর কটা দিন ধৈর্য ধরো আক্কাস, দিয়া দিবনি!’
‘সে তো নিত্যি কইচ্চ!’
‘কী কর্যা দিব কও! আয়-ইনকাম থাকলে তো? যা কামাই করি তা তো তোমার এটিই ঢাল্যা যাই বাপু! ঘরেত তো কিছু লিয়্যা যাই না!’
আক্কাস চাল মাপতে মাপতে ফিরে তাকায় রমিজের দিকে। চাহনিটা বড়ই তাচ্ছিল্যের ঠেকে রমিজের কাছে।
‘রমিজ ভাই, বানর খেলা-ট্যালা বাদ দ্যাও। উসব আর কেউ দ্যাখে না! অন্য কাম ধরো!’
‘অন্য কাম ধরার কি আর জো আছে রে বাপু! সে আর শিখল্যাম কই!’ রমিজের কথায় দীর্ঘশ্বাস। বুকের ভেতরটা যেন হুহু করে ওঠে তার। চলনবিলের ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ে পাঁজরার খাঁচায়।
আক্কাস চাল মাপা শেষ করে আলু মাপা শুরু করে। ‘আর যুদিল জাত ব্যবসা ছাড়তেই না পারো রমিজ ভাই, তাইলে রাহেলারেও সাথে লও। বানর খেলা দেখ্যা তো মানষে পয়সা দিবি ন্যা, দিলে তোমার জুয়ান বেটিক দেখ্যা দিবি! মেয়েডা তো ভালই ডাগর-ডুগর হসে!’
আড় চোখে তাকিয়ে আক্কাস খ্যাকখ্যাকিয়ে হেসে ওঠে। রাগে গা জ্বলে ওঠে রমিজের। মনে হয় পায়ের ক্ষতবিক্ষত স্যান্ডেলটা খুলে ছুঁড়ে মারে ওর মুখের ওপর। কিন্তু পারে না রমিজ। কী যেন এক অদৃশ্য যাদুবলে চুপসে যায় সে। আক্কাস সওদাগুলো এগিয়ে ধরে। কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে রমিজ সেগুলো নিয়ে পোঁটলায় পুরে ফেলে। তারপর কুঁচামুরগীর মত কুঁচ কুঁচ করতে করতে ঘুরে দাঁড়ায়।
আক্কাস বাকি পরিশোধের চাপ দিতে থাকে। আর সে কোন কথাই শুনতে চায় না। ‘অনেক টাইম নিস বাপু, আর লয়! তিন দিন সময় দিলাম, এর মধ্যে টাকা শোধ দিবা, নাইলে কিন্তু ভাল হবিন্যা!’
দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় রমিজ। আক্কাস যেভাবে কড়া ভাষায় শাসিয়েছে তাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেনা শোধ করে দেয়া উচিৎ। তাছাড়া লোকটাকে দেখলেই পিত্তি জ্বলে যায় তার। আজকাল সহ্যই করতে পারে না সে। সুযোগ পেলেই আজেবাজে কথা বলে। আর তার খ্যাকখ্যাকানি হাসি শুনলে মাথার চাঁন্দি গরম হয়ে যায়। ভোতা ছুরি দিয়ে খুন করলেও রাগ মিটবে না তার।
কিন্তু উপায় কী! রাহেলা বানরটাকে বিক্রি করে দিতে বলে। রমিজ আঁৎকে ওঠে। অসম্ভব! মরে গেলেও বানরটাকে বিক্রি করবে না সে। এটা শুধু তার উপার্জনের বাহন তাই নয়, সুখে দুখে একমাত্র অবলম্বন তার। ‘তুক যেমন বেচতে পারবো না রে মা, তেমনি রাজাকও না।’ রাহেলাও জানে সে কথা। এছাড়া আর কোন পথ তো খুঁজে পায় না সে।
৩.
সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেল রমিজের। কী আর করবে! এই বয়সে সারাদিন ধরে যে পরিশ্রম করতে হয় তাতে শরীর তো আর পারে না! মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়। হুড়মুড় করে উঠে বসে রমিজ। কলসি থেকে পানি ঢেলে খায়। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কত বেলা হলো আঁচ করার চেষ্টা করে। না, অনেক বেলা হয়ে গেছে। এখনই বের হয়ে পড়া দরকার। সে বাইরে তাকিয়ে হাঁক দেয়, রাহেলা?
রাহেলার কোন সাড়াশব্দ নাই। মাজনের শিশি থেকে মাজন হাতে ঢেলে আবার ডাকে রমিজÑ ‘ক্যারে রাহেলা, কই গেলু! পন্তা-টন্তা যা আছে দে, আইজ ব্যান দেরিই হয়্যা গেল…!
রাহেলার কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে রমিজ গামছাটা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। সামনে দৃষ্টি পড়তেই থমকে দাঁড়ায় সে। কলপাড়ের ওপারে রাজাকে নিয়ে আপন মনে খেলছে রাহেলা! রাজাকে নিয়ে খেলার জন্য সে অবাক হয়নি। কেননা খেলা দেখিয়ে বাড়ি আসার পর রাজার পরিচর্যা রাহেলাই করে। রাতে খাওয়ায়। ঘুমানোর জায়গা করে দেয়। সকালে গোসল করিয়ে গা মুছে দেয়।
রমিজ থমকে গেছে ভিন্ন কারণে। আজ যে রাহেলাকে সে দেখছে সে যেন অন্য রাহেলা। কেমন অচেনা ঠেকে তার কাছে। আপন মনে রাজার সাথে খেলছে রাহেলা। খুবই একান্তে, নিবিড়ভাবে। তার চোখের ভাষা অচেনা। মুখম-লের ভাষা আলাদা।
সেই কোন শৈশবে এমন একান্তে পুতুল খেলতো রাহেলা। পুতুলগুলোকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বিড়বিড় করে কত কথাই যে বলতো তার ইয়ত্তা নাই! মুহূর্তে রমিজের চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। সংসারের ঘেরাটোপে পড়ে শিশুকাল পার হওয়ার আগেই পুতুল খেলা ছাড়তে হয়েছে রাহেলাকে। কিন্তু আজকের রাহেলা রমিজের চোখে ভেসে ওঠা সেই শৈশবের রাহেলাও না। এ রাহেলাকে সে আর কোনদিনই দেখেনি।
সামনে মৃদুপায়ে একটু এগিয়ে যায় রমিজ।
রাহেলা রাজার শিকল ধরে টান দেয়। ‘কও তো রাজাবাবু, নতুন বর কীভাবে মুখেত রুমাল দিয়্যা বিয়া করতে আসে?’
রাহেলার কথায় রাজা তা ভঙ্গি করে দেখায়।
‘নাহ! হচ্চে না তো! নতুন বরের লজ্জা কই?’
রাজা ভঙ্গি করে দেখায়। রাহেলা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ‘নতুন বরেক দেখ্যা বউ ঘুমটার আড়াল থেক্যা কেমন কর্যা আড় চোখেত তাকায়, দেখাও তো বাপু!’ রাজা ভঙ্গি করে করে দেখায়।
‘ নতুন জামাই মিস্টির হাঁড়ি নিয়ে কীভাবে শ্বশুরবাড়ি আসে, দেখাও তো রাজাবাবু!’
রাজা সুন্দরভাবে ভঙ্গি করে দেখায়। হঠাৎ রাহেলা উদাস হয়ে যায়। বুকের হাঁপরে জমে থাকা একগাদা বাতাস দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে। ‘ই-বাড়িত আর নতুন জামাই আসবিন্যা রে রাজাবাবু!’
রমিজ বুঝতে পারে রাহেলার কথার ভেদ।
মেয়েটার মনের মধ্যে বিরাজ করছে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। বাপ হিসেবে তার এই স্বপ্ন পূরণ করা দায়িত্ব! মা-মরা মেয়েটার এসব খোঁজ খবর তো তাকেই রাখতে হবে। কেন যে একবারও মনে আসেনি সে কথা! ভেবে অনুশোচনা বোধ করে রমিজ।
আসলে মেয়েদের কিছু বিষয় থাকে যা একমাত্র মায়েরাই মনে রাখতে পারে, বাবারা পারে না। আজ যখন বুঝতে পেরেছে তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করাই ভাল। রমিজ সে দিনই ছুটে যায় দেরাজ ঘটকের কাছে।
‘শোন রমিজ ভাই, পাত্র যে পাওয়া যাবিন্যা তা লয়! তোমার এই পেশাটা ছাড়।’
দেরাজ ঘটকের কথায় হোঁচট খায় রমিজ। ‘ক্যা, পেশা ছাড়া লাগবি ক্যা?’
‘মেয়েক বিয়া দিতে হলে, ছাড়া তো লাগবি! বান্দরওয়ালার মেয়ার সাথে কেডাই ছাওয়ালে বিয়া দিবি কও? শ্বশুরবাড়ির পরিচয় তো দেয়া লাগবি, নাকি!’
রমিজ বড়ই হতাশ হয়। শত অভাবেও জাত পেশাটা ছাড়তে পারেনি। আজ মেয়ের বিয়ে দিতে হলে পেশা ছাড়তে হবে ভেবে বড়ই দোটানায় পড়ে রমিজ। মেয়ের সুখ বলে কথা! বাপ হিসেবে আজ এ কোন পরীক্ষার সম্মুখিন হল সে!
সারাদিন শহরের অলিগলি ঘুরেছে রমিজ, কিন্তু কোন মজমাই বসায়নি। একবারও হাঁক দিতে পারেনি সেই চিরচেনা সুরে, দেখবেন বানর খেলা….! হাতের ডুগডুগিটা যতবারই বাজানোর জন্য উদ্যত হয়েছে ততবারই মনে হয়েছে রাহেলার টুঁটি চেপে ধরে আছে সে! পেটেও কিছু পড়েনি সারাদিন। না তার নিজের, না রাজার। বুকের ভেতর অযুত বানর সারাদিন খেলা করেছে তার। হৃদপি-ে মাতন তুলেছে অজস্র ডুগডুগির অবিরত তরঙ্গ। কোন পথ বেছে নেবে সে?
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রমিজ। বড় রাস্তার কোলে এসে ঘাসের উপর বসে পড়ে। মনে হয় এ শরীর যেন তার নয়। বলহীন, অনুভূতিহীন। রাজা এসে তার শিওর ঘেঁষে দাঁড়ায়। এক ঝটকায় তাকে বুকে টেনে নেয় রমিজ। হাতের আঙুলগুলো রাজার শরীরে বিলি কাটতে থাকে। ডুকরে কেঁদে ওঠে রমিজ। তারপর একসময় কান্না থিতিয়ে এলে রাজার গলার শিকলটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার পাশের নয়ানজুলিতে। ‘যা রে রাজা, বনের বান্দর বনেত ফির্যা যা। যেদিক খুশি সেদিক চল্যা যা।’
রাজা যায় না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে রমিজের দিকে। রমিজ উঠে দাঁড়ায়। বড় রাস্তা ছেড়ে নেমে আসে মেঠো পথে। রাজা তাকে অনুসরণ করে।
‘ক্যারে, যাচ্চু না ক্যা? কল্যাম না, তুই চল্যা যা। জীবনেও আর এমুখ হবু না।’ রাজা থামে না। হাঁটতেই থাকে। রামিজ ঝোলা থেকে ছড়ি বের করে রাজার দিকে তেড়ে যায়। রাজা ছুটে পালায়।
৪.
আক্কাসের দোকানের সামনে এসে সম্বিত ফিরে পায় রমিজ। আজ তো একটা পয়সাও উপায় হয়নি। যাবে কি যাবে না ভাবতে থাকে। আক্কাসের উপর জমে থাকা সমস্ত ক্রোধ উধাও হয়ে যায়। পিঁপড়ের মত পায়ে বিলি কেটে কেটে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘ক্যারে বাপু, তিনদিন তো পার হয়্যা গেল, ট্যাকা দেও!’
রমিজ কী বলবে ভেবে পায় না। ঝুড়ি থেকে কলার থোকা তুলে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে খ্যাঁকখেঁকিয়ে ওঠে আক্কাস, ‘ট্যাকা আনিসো? আইজ কিন্তু তোমাক ছাড়িচ্চিন্যা বাপু!’
‘আমাক সময় দেয়া লাগবি, বেসি লয়, আর এক সপ্তা!’
‘আর একদিনও লয়। ট্যাকা দিয়্যা এটি থেক্যা যাবা।’
‘থাকলে তো দিবো আক্কাস! এরম জোরাজেুরি করলে হবি?’ রমিজের যেন হঠাৎ কণ্ঠ ফিরে পায়!
‘গরম দেখাচ্চ ক্যা রমিজ ভাই? আমি কি বাকি দিয়্যা অন্যায় করিসি? বেশি গরম দেখায়োনা!’
‘কি করব্যা? আটকায়্যা রাখবা? রাখো! কাট্যা টুকরা টুকরা কর্যা ফেললেও ট্যাকা দিতে পারবো না।’ কামানের গোলার মত কথাগুলো বেরিয়ে আসে রমিজের কণ্ঠ ফুঁড়ে। আক্ষেপ না ক্রোধ বোঝা যায় না। সত্যিই তো কী করবে সে! আক্কাস যা করার করবে।
‘কলেই তো হবিন্যা! পাওনা ট্যাকা। ট্যাকা তো আর আকাশ থেইকা বৃষ্টির লাখান ঝর্যা পড়ে না। ট্যাকা গাছের পাতাও না! ট্যাকা দিয়া তারপর কুনো কথা থাকলে কও রমিজভাই!’
‘তুমার যা খুশি করো আক্কাস। মারলে মারো, কাটলে কাটো, আমার কাছে ট্যাকা নাই।’
আক্কাস তাচ্ছিল্লের সাথে ঘুরে তাকায়। ‘ঘরের ডাগর মিয়্যা আছে না! মাঝে মাঝে পাঠায়্যা দিও! ট্যাকা দিতে হবিন্যানি।’
নিজেকে আর সামাল দিতে পারেনা রমিজ। অসুর ভর করে শরীরে। ক্ষিপ্র ক্ষুধার্ত বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্কাসের ওপর। শার্টের কলার ধরে টেনে বের করে এনে কষে কয়টা চড় বসিয়ে দেয় গালে।
আকষ্মিকতায় হকচকিয়ে যায় আক্কাস। ততক্ষণে বিষ নির্গত করে নিজেকে সামলে নিয়েছে রমিজ। প্রচ- অপমানে ফুঁসতে থাকে আক্কাস। পাল্লা থেকে বাটখারাটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে তেড়ে যায় রমিজের দিকে। মুহূর্তে পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজা। রাজাকে দেখে চুপসে যায় আক্কাস। বাটখারাটা খসে পড়ে হাত থেকে। রামিজ আর দেরি করে না। পোঁটলাটা কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটা দেয়। রাজাও তাকে অনুসরণ করে।
৫.
‘ও বাপ, তাড়াতাড়ি বাইরাও… দেখ কী হইসে!’
রাহেলার চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় রমিজের। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। ছুটে আসে ঝুপড়ি ঘরের দিকে। সবে আলো ছড়াতে শুরু করেছে সূর্য। পাখিদের কিচিরমিচির খেলা তখনও থামেনি। রমিজ দেখতে পায় মাটিতে টান হয়ে পড়ে আছে রাজার দেহ। পেছনের একটা পা ঈষৎ উপরে; টানটান হয়ে আছে। চোখ দু’টো খোলা। মুখগহ্বর থেকে জিহ্বা কাত হয়ে ঝুলে আছে একপাশে।
‘তোমার রাজা আর নাই বাপজান, অরে মার্যা ফেলিসে!’
রমিজ দেখতে পায় রাজার চারপাশে পড়ে আছে কয়েকটা কলার খোসা আর আধ খাওয়া কলার টুকরো। গতকাল সন্ধ্যায় এরকমই কলা সে আক্কাসকে দোকানে ঝুলাতে দেখেছিল।
রাজার খোলা চোখে চোখ পড়ে রমিজের। চোখের সামনে তখন অদৃশ্য অজস্র বানর খেলা করতে থাকে। নানান ঢঙে, নানা ভঙ্গিতে। এতগুলো বানর কোনদিন একসাথে দেখেনি রমিজ। বুকটা উথাল-পাথাল করে ওঠে তার। ছুটে গিয়ে পোঁটলা থেকে বের করে আনে ডুগডুগি। উন্মত্তভাবে বাজাতে থাকে সেটা।
রমিজের কণ্ঠনালি ফুঁড়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে সেই চিরচেনা সুরÑ‘দেখবেন বানর খেলা….!’