রাত এগারোটা সাত।
আমি লিখছি ।
আমি সাধারনত এগারোটার পর লিখতে বসি। চারপাশটা একটু নীরব সুনসান হলে। এমন কি আমার বউও ঘুমিয়ে গেলে।
হঠাৎ আমার ফোনের মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ এলো,ভাইয়া কেমন আছেন?
আমি লেখা থামিয়ে প্রোফাইল চেক করলাম। সূবর্ণা চৌধুরী। বেশ ভারি নাম । প্রোফাইলে একটামাত্র ছিমছাম শ্যামলা কালারের মেয়ের ছবি । বাদবাকি কিছু ফুলফল ,শাক-সবজি।
সূবর্ণা চৌধুরী। না, এইনামে আমি কাউকে চিনিনা। কিভাবে সে আমার সঙ্গে এ্যাড হয়েছে তাও মনে করতে পারছি না। হয়তো ওই রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল। আমি একসেপ্ট করে নিয়েছি। মেয়ে মানুষের রিকুয়েস্ট এড়ানো কঠিন।
যদি এই মেয়েটাই সূবর্ণা চৌধুরী হয়ে থাকে তাহলে খুব একটা খারাপ না। আবারও একটা মেসেজ, চিনতে পারছে না, তাই তো !
আমি কিছুক্ষণ না লিখে চুপচাপ বসে থাকলাম।
-আমি আপনার একজন ভক্ত। আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগে। আমি রাত জেগে আপনার লেখা পড়ি।
আপনার লেখা অনেক মানবিক ,অনেক দরদী। আমাকে অনেক মুগ্ধ করে আপনার লেখা।
-ও আচ্ছা , ধন্যবাদ ।
-আমি কি আপনাকে বিরক্ত করছি ?
-না, ঠিক আছে।
-আমি আপনাকে একটা গল্প বলতে চাই।
-তাই!
-জ্বী।
-বলুন।
-এখন না।
-কখন?
-আমার যখন ইচ্ছে হবে। মন ভালো থাকবে।
-আপনার মন কি এখন খারাপ?
-খারাপ ছিলো। এখন আপনার সঙ্গে চ্যাট করে আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাচ্ছে।
-ও, আচ্ছা।
হঠাৎ করেই ওর মেসেঞ্জার অফ।
আমি আবারও ওর প্রোফাইল দেখলাম। না, তেমন কিছুই নেই। ঐ একটাই শুধুমাত্র ছবি। আমি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, ছোট করে, বড় করে ছবিটা দেখতে লাগলাম।
আমি ভাবছি আমার মতো এমন ভাঙা-চোরা লেখকেরও ভক্ত থাকে! তাও আবার মেয়ে ভক্ত! এরকম অল্প বয়সের তন্বী-তরুণী।
আমার হাতের লেখাটা আজ শেষ করতে হবে। কিন্তু পারছি না। আমি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে সন্ন্যাস নিলাম। হাতের লেখাটা শেষ করতেই হবে।
পরের রাত। ঘড়িতে এগারোটা পঞ্চাশ। আমি লিখছি না। গান শুনছি। মোহাম্মদ রফির ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন দিল বহি মেরা ফাস গায়ি…’ নজরুল সঙ্গীত। নজরুল সঙ্গীত আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। মেসেঞ্জারে টং করে একটা শব্দ হলো, ভাইয়া আছেন!
-জ্বী, বলুন।
-কি করছেন?
-গান শুনছি।
-গান! কার গান?
-নজরুল সঙ্গীত। তুমি একটা গল্প বলতে চেয়েছিলে!
-জ্বী, বলবো। অবশ্যই বলবো। অতো তাড়া কেনো!
-না, কোনো তাড়া নেই।
আমিও ভাবছি এরকম সুন্দরী একজন নারীর সংসর্গ এতো তাড়াতাড়ি শেষ করা ঠিক হবে না। আমি তো আর গৌতম বুদ্ধের মতো মহাপুরুষ নই। আমার চিত্ত টলতেই পারে।
-আপনার ঐ গল্পটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
-কোন গল্পটা?
-ঐ যে একটি ছোট বাচ্চা। তার মা’র ডিভোর্স হয়ে যাওয়া। বাকি জীবনে কঠোর সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা।
-গল্পটার নাম কি?
-ছেঁড়া গোলাপ।
-ও, আচ্ছা।
-আমি আপনার জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
-আমার জীবন মানে?
-আপনার ব্যক্তিগত জীবন।
-এতো কথা লিখতে ইচ্ছে করছে না।
-তো! তাহলে কি ফোন দিবো?
-না। এখন কথা বলা যাবে না।
আবারও মেসেঞ্জার অফ।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। নজরুল সঙ্গীত শেষ হয়েছে। অন্য একটি গান বাঁজছে। ফজলুর রহমান বাবুর ‘ অল্প না বয়সের ছকিনা ছেড়ি…’
আমি আমার রুমের মধ্যে একটু পায়চারি করলাম। তারপর দরজাটা আস্তে করে টেনে দিয়ে রুবার রুমে এলাম। পৃথী আর রুবা দু’জনই গভীর ঘুমে নিমগ্ন। আমি জগ থেকে আধা গ্লাস পানি খেয়ে চুপচাপ রুবার পাশে শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন। না, পরের দিন নয়, পরের রাত।
এগারোটা পাঁচ। আমি ডেটা অন করতেই সূবর্ণাকে এ্যাকটিভ পেলাম। আমার অপেক্ষাতেই ছিলো কি না কে জানে! টং করে একটা মেসেজ এলো।
ও একটা ছবি পাঠিয়েছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে এই ছবিটার সঙ্গে প্রোফাইলের ছবিটাকে মেলানোর চেষ্টা করলাম। একবার মেলে, একবার মেলে না। অবশেষে চোখ এবং নাক ধরে মিলিয়েই ফেললাম। হ্যাঁ, ঠিক আছে। একই ছবি। আমি আরও একটু নিশ্চিৎ হওয়ার জন্য ওকে এখনকার একটি ছবি পাঠাতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আরও একটা ছবি পাঠালো। তবে এবারের ছবিটা একটু অন্যরকম। একটু এলোমেলো। একটু অগোছালো। একটু খোলামেলা।
এভাবেই আমাদের সম্পর্কটা এগোতে লাগলো। আমিও মাঝে মাঝে দু’একটা ছবি পাঠাই। ও আমার জীবন বৃত্তান্ত শুনতে চায়। আমার চলাফেরা, আমার দৈনন্দিন রুটিন। আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দ-অপছন্দ। আর আমিও যেনো ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’।
আমি একদিন ওর কাছে ওর গল্পটা শুনতে চাই যেটা ও আমাকে বলতে চেয়েছিলো। ও আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। গল্পটা সামনা-সামনি বলবে।
কিন্তু আমি জানি দেখা করলে আমার আকর্ষণ কমে যাবে। এর আগেও বহুবার এরকম হয়েছে। আমি কষ্ট পেয়ে ফিরে এসেছি। আমি দূর থেকে যতোটা সুন্দরী ভাবছি ও হয়তো তার ছিটেফোঁটাও নয়। ও হয়তো এমন একটা কটকটে ওড়না পরবে, দেখলেই আমার বমি চলে আসবে। কিন্তু তবুও আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। আমি দেখা করার জন্য রাজী হয়ে যাই। অন্তত ওর গল্পটা আমার শোনা উচিৎ।
পরের দিন বিকেল পাঁচটায় টাইম ফিক্সড হয়। অর্কিড রেঁস্তোরা। ও সবুজ রঙের শাড়ী পরে আসবে আর আমি সাদা পাঞ্জাবী।
সত্যিই নিজেকে কেমন ফুরফুরে লাগতে লাগলো। যেনো বহুদিন পর এক পশ্লা সতেজ বাতাস আমার হৃদপিন্ডের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলো।
নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে নিলাম। বউকে বলে গেলাম কবিতা পাঠের আসরে যাচ্ছি।
রেঁস্তোরাটা বেশ ছিমছাম। পরিচ্ছন্ন। সামনের লনে অনেক সবুজ। ভিতরে বসার সুন্দর ব্যবস্থা। অনেকগুলো চেয়ার-টেবিল সারি সারি সাজানো। বেশির ভাগই ফাঁকা।

কোনের টেবিলে সবুজ শাড়ী পরা সূবর্ণা। আমি কাছে যেতেই আমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে গেলো। প্রেসার এক লাফে একশ বিশ থেকে একশ নব্বই-এ চলে গেলো। মাথার মধ্যে নিউরনে ব্যাড সিগনাল দিতে লাগলো। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি!
ও রাগ করলো না। মৃদু হেসে বললো, বসো। কিন্তু আমি বসতে পারলাম না। আমার পা দু’টো যেনো পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে গেলো। আমি অনুভব করলাম এই এসি’র মধ্যেও আমার শিরদাঁড়া বেঁয়ে শীতল ঘাম নেমে গেলো। ও আবার বললো, কি হলো বসো !
আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমি এরকমভাবে কট হয়ে যাবো। আমার নির্ঘাত ফাঁসি হয়ে যাবে। আর যদি ফাঁসি নাও হয় তাহলে এই ঘটনাটা নিয়ে সে আমার বাকি জীবন তামা তামা করে দেবে।
ও আগেই কি সব অর্ডার দিয়ে রেখেছিলো। একে একে সেসব খাবারগুলো আসতে লাগলো। ও ওর প্রিয় খাবারগুলো আয়েশ করে খেলো। তারপর কিছু খাবার পৃথীর জন্য প্যাক করে নিলো। যাবার সময় বলে গেলো, পকেটে নিশ্চয় অনেকগুলো টাকা নিয়ে এসেছো! আজকের বিলটা না হয় নিজের বউ-বাচ্চার জন্য দিয়ে দিও।