শিক্ষা জাতির মেরুদ-। আর সেই মেরুদণ্ড একটি জাতিসত্ত্বার সামগ্রিক বিকাশের প্রধান হাতিয়ার। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লালিত স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতির অভিশপ্ত কালরাত ১৫ আগস্ট পেরিয়ে পরবর্তী সময়ে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে যিঁনি ব্যক্তিগত বুদ্ধিদীপ্ত কর্মপরিকল্পনায় সফল একটি রাষ্ট্রযন্ত্রে পরিণত করেছেন তিনি জাতির পিতার সুযোগ্য কণ্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।
তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় উচ্চ শিক্ষার প্রসারে দেশের প্রতিটি জেলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একটি করে সাধারণ অথবা বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সরকারের পরিকল্পনার কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বলেছেন। বিগত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এসব কথা বলেন। ২০০৯ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ পরিকল্পনার অংশ বলেও জানান তিনি।
পরবর্তীতে ২৫ জুন ২০২০ তারিখ নাটোর জেলায় দুইটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের কাছে সিদ্ধান্ত চেয়ে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। জরুরী ভিত্তিতে এই মতামত জানাতে বলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় দুটি স্থাপনের জন্য সম্ভাব্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে নাটোর সদর ও সিংড়া উপজেলা। সদরের বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ‘ডক্টর ওয়াজেদ আলী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’। আর সিংড়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ‘নাটোর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’।
২৫ জন বৃহস্পতিবার এ তথ্য নিশ্চিত করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারী সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব নীলিফা আফরোজ।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে দেশের প্রতিটা জেলায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক নাটোর জেলাতে শুধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং আমরা সমগ্র নাটোরবাসীর পক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী জানাচ্ছি।
কবির কল্পনায় নাটোর অমর হয়ে আছে কাব্যে। প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রতœতাত্ত্বিক ঐশ্বর্য্য ম-িত বরেন্দ্র ভূমি সংলগ্ন নাটোর জেলা। ২৪.২৬০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯.৯০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে নারদ নদের উত্তর তীরে নাটোর শহর অবস্থিত। আধুনিক কালের এ শহরটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের শতাব্দীর গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এক অধ্যায়। একে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ সামন্তরাজ ও এক মহীয়সী নারীর রাজ্য শাসন ও জনকল্যাণ ব্যবস্থা। কথিত আছে মোঘল আমলের পাঠান জমিদার লস্কর খাঁ তাঁর সৈন্য সামস্তদের জন্য যে সহান (বর্তমান পুঠিয়া এলাকা) হতে রসদ সংগ্রহ করতেন, কালক্রমে তার নাম হয় লস্করপুর পরগনা। এই পরগনার একটি নিচু জলাভূমির নাম ছিল ছাইভাংগা বিল। ১৭১০ সনে রাজা রাম জীবন রায় এ সহানে মাটি ভরাট করে তার রাজধানী সহাপন করেন। কালক্রমে তা প্রাসাদ, দীঘি, উদ্যান, মন্দির ও মনোরম অট্টালিকা দ্বারা সুসজ্জিত নগরীতে পরিণত হয়। মোঘল আমলের কিছুকাল বর্তমান নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা গ্রামে চাপিলা পরগনার কেন্দ্র এবং পরবর্তীতে জেলা সদর ছিল বলে জানা যায়। পরে চাপিলা অস্বাস্থ্যকর স্থান বিবেচিত হওয়ায় জেলা সদর নাটোরে স্থানান্তরিত হয়। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাটোরে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার সদর কার্যালয় ছিল। স্বাস্থ্যগত কারণে বিশেষ করে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে ইংরেজ সরকার ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে জেলা সদর নাটোর হতে রামপুর বোয়ালিয়ায় (বর্তমান রাজশাহী) স্থানান্তর করেন। নাটোর মহকুমা সৃষ্টি হয় ১৮৪৫ সালে। নাটোরকে স্বাস্থ্যকর করে গড়ে তোলার জন্য ১৮৬৯ সালে নাটোর পৌরসভা স্থাপিত হয়। ১৯৮৪ সালে নাটোর মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তরিত হয়।
কথিত আছে যে, বর্তমান নাটোর শহরের উপরেই এক সময় চলন বিল বিস্তৃত ছিল। জনৈক রাজা নৌকাপথে সেই স্থানের নিকট দিয়ে যাবার সময় একটি বেঙ কর্তৃক সাপকে ধরা দেখে নৌকার মাঝিদের ‘নাও ঠারো’- অর্থাৎ নৌকা থামাও; মতান্তরে ‘ন ঠারো’- অর্থাৎ নৌকা থামিও না বলেন। এরূপ বলার কারণ, তখন জলপথে দস্যু তস্করের আক্রমণ হতো। তারাও দস্যু কবলিত হতে পারেন- এই আশংকায় তাড়াতাড়ি উক্ত স্থান ত্যাগ করাই হয়তো শ্রেয় মনে করেন। আবার হিন্দু ধর্মমতে বেঙ সাপকে ধরলে মনসাদেবী ক্রোধান্বিত হন। সুতরাং নৌকা থামিয়ে মনসা পুজা করাই হিন্দু রাজার পক্ষে অধিক সংগত। তাই জন্য ‘নাও ঠারো’ অথবা ‘ন ঠারো’ কথা হতেই নাটোর নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
ঐতিহাসিকদের মতে অষ্টাদশ শতকে নাটোর রাজবংশের উৎপত্তি। উত্তরবঙ্গের জমিদারগণের মধ্যে নাটোর রাজ মান-মর্যাদা ও বিষয় সম্পত্তিতে ছিলেন অগ্রগণ্য। রাজা রামজীবন রায় নাটোর রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। রামজীবনের পালিত পুত্র রামকান্ত রায়ের সাথে বগুড়া জেলার ছাতিয়ান গ্রামের আত্মারাম চৌধুরীর একমাত্র কন্যা ভবানীর বিবাহ হয়। রাজা রামজীবন রায় ১৭৩০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি রামকান্ত রায়কে রাজা এবং দেওয়ান দয়ারাম রায়কে তার অভিভাবক নিযুক্ত করেন। রামকান্ত রাজা হলেও প্রকৃত পক্ষে সম্পূর্ণ রাজকার্যাদি পরিচালনা করতেন দয়ারাম রায়। তাঁর দক্ষতার কারণে নাটোর রাজবংশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটে। ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্ত পরোলোক গমণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর রাণী ভবানী জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নাটোরের ইতিহাসে তিনি জনহিতৈষী মহারাণী হিসাবে অভিহিত এবং আজো তাঁর স্মৃতি অম্লান। বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার সংগে রাণী ভবানীর আন্তরিক সুসম্পর্ক ছিল। কথিত আছে পলাশীর যুদ্ধে রাণী ভবানী নবাবের পক্ষ অবলম্বন করেন।
পরবর্তীতে রাণী ভবানী নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। দিঘাপতিয়ায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান উত্তরা গণভবনটি দয়ারামের পরবর্তী বংশধর রাজা প্রমদানাথের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। কালক্রমে এই রাজপ্রাসাদটি প্রথমতঃ গভর্ণর হাউস ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পরে উত্তরা গণভবনে পরিণত হয়। এই সুমহান ঐতিহ্যের ধারক-বাহক নাটোর জেলার আদি সম্মান আর আভিজাত্যকে সম্মান জানাতেই শুধু কৃষি নয় একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সর্বাত্মক দাবী। কেননা, শুধু কৃষি নামে বিশেষায়িত কোন খ-িত বিশ্ববিদ্যায়তন নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যায়তনের সামগ্রীক পরিবেশ রয়েছে দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যম-িত এই নাটোর জেলার। দেশের সকল নীতি নির্ধারক ও শিক্ষানুরাগীদের সহৃদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেই পূনরায় দাবী জানাচ্ছি- আমরা নাটোরবাসী সকল সুযোগ-সুবিধাসহ একটি আধূনিক যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ একটি বিশ্ববিদ্যালয় নাটোরে চাই। (চলবে)
ড. হাসান রাজা, লেখক ও গবেষক, নাটোর