দিনভর বিষ্টি আর বিষ্টি। গর্জন নেই মেঘের। নেই দমকা বাতাস শিলা-ঝড়। শরতের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও বিষ্টি নিরন্তর ঝরছে। পাকিস্তানিরা এমন বিষ্টি দ্যাখেনি কখনো। বিষ্টিতে তাদের যাতায়াত সীমিত হয়ে গ্যাছে। তারা তো আগেই সব দখলে নিয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে আর ক্যানো বেরোবে? দায় আমাদের, ওদের হটিয়ে নিজেদের মাটি দখল নেয়া। দেশকে শৃঙ্খলমুক্ত করা। কমান্ডার আমাদের অনুপ্রাণিত করেন, কিন্তু আমরা আর সামনে এগোতে পারছিনে। পেটে ক্ষুধা। হাঁটতে হাঁটতে ঠ্যাঙে-পায়ে ব্যথা জমে গ্যাছে। রেকি এসে জানালো, সামনের গাঁয়ে ভালো সেল্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বস্ত মানুষ। তার কথা শুনে মনে শক্তি ফিরে এলো। রেকির নির্দেশিত পথে সবাই এগোতে শুরু করলাম। তখনও সন্ধে হয়নি। কাক-পাখি ভিজে ভিজে নিজেদের আস্তানায় ফিরছে। ক্যাবল আমাদেরই কোনো সুনির্দিষ্ট আস্তানা নেই। ওমরভাই আর মারফতের গামছায় দু’মুঠো করে মুড়কি আর চিড়ে ছিলো, সেই কখন বিকেলে কাড়াকাড়ি করে খেয়ে শেষ করেছি। গামছা এখন ওদের কোমরে বেঁধে ক্ষুধার পেটে শক্তি জোগাচ্ছে।
সন্ধেতক গিয়ে উপস্থিত হলাম গফুর মিয়ার বৈঠকখানায়। বেশ বড়ো আর পরিস্কার বৈঠক। খড়ের বেণী পাকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। তামাক-হুঁকোও দেয়ালের ভেতরে তৈরি করা একটা ছোট্ট খোপে সাজিয়ে রাখা। যে তামাক খাবে, সে কল্কেয় তামাক ভরে ওই খড়ের বেণীর আগুন ভেঙে তাতে বুড়ো আঙুলে চেপে দিয়ে টানলেই ইপ্সিত নিকোটিন মেলাতে পারবে। আমাদের কয়েকজন বৈঠকে উঠেই হুঁকো টানতে শুরু করলেন। গফুর মিয়া এসে প্রত্যেকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেও হুঁকো টানলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘এক্কিবারে দুধের ছোল বারে, ই যুদ্ধ কোরবি কি কোর্যা? ছোলের সাওস আছে।’ বলে আমার মাথায় হাত দিয়ে দোআ করলো। বগুড়া-জয়পুরহাট জেলার মানুষ এ ভাবেই কথা বলে। তখনো জয়পুরহাট জেলার মর্যাদা পায়নি। মহকুমা। জয়পুরহাটের কুখ্যাত দালাল আব্দুল আলীম। তার দাপটে এলাকা কম্পমান। বাহিনীও বিরাট ও শক্তিশালী। পাকিস্তানিরা তাকে পাহারা দ্যায়। আমাদের ছোট বাহিনী তাকে ক্যাবল উৎপাত করতে পারবে, আশানুরূপ ক্ষতি করতে পারবে না। পাবনার জয়নাল ভাই দলের সেরা সাহসী ও শক্তিমান যোদ্ধা। তিনি কমান্ডারের অনুমতি চাইলেন আলীমের থানা পর্যায়ের দু’একটা ঘাঁটি একটু নেড়ে দিতে। কমান্ডার সম্মত হলেন না। বললেন, ‘চুলগুলো ছিঁড়তে না পারলে খামোখা খামচে কী লাভ? বাঘের সঙ্গে লড়তে হলে শক্ত শাবল চাই। আরো চাই অস্ত্র-যোদ্ধা। আছে তোর?’ তিনি সবাইকে গোফুর মিয়ার ঢাকিতে করে পাঠানো গুড়-মুড়ি খেতে বলে নিজেও দু’চার কোল মুখে ভরে জল খেয়ে একবার তামাকের দিকে ঝুঁকলেন। আমাদের সামনে খাসি জবাই হলো। পুকুর থেকে মাছ তুলে কাটা হচ্ছে। দেখে তো আমরা আনন্দে আত্মহারা। কামান্ডারও। সবাইকে শুয়ে বিশ্রাম করার নির্দেশ দিলেন। দু’জন স্ট্যান্ড বাই এক ঘণ্টা করে ডিউটি করবেন। শুরু হলো ডিউটি। তখনও বিষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশ সহগ্র সহগ্র ফুটোয় ছিন্নভিন্ন। একবারের জন্যেও থামার নাম নেই। রাত এগিয়ে চলছে। কিন্তু খাওয়ার ডাক আর আসে না। কারো চোখে ঘুম আসছে না। সবাই তন্দ্রাচ্ছন্ন। জয়নাল ভাই খাসি জবাই দেখে কমান্ডারকে বলেছিলেন, ‘লক্ষণ সুবিধের নয়। গফুর মিয়ার কথাবার্তা আর আয়োজন আমাদের জন্যে বলে মনে হচ্ছে না। এরমধ্যে কিছু কিন্তুক আছে কমান্ডার।’ কমান্ডার তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দ্যান। জয়নাল ভাই হুঁকো টানেন আর মাথা নাড়েন। সে মাথার ইঙ্গিত শুভ সংকেত দ্যায় না। আমরা ক্যাবল তার অস্থিরতা লক্ষ করি আর নিঃশব্দে হাসি। অপেক্ষায় থাকি, কখন খাওয়ার ডাক আসবে। আজ রাতে মহাভোজ…
ভেতর থেকে খাবারের ডাক আসে না, আর কতোক্ষণ ক্ষুধার এই আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। এ সব এলোমেলো ভাবনার মধ্যে বসে ঝিমোচ্ছি আমরা। কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন। বাইরে জয়নাল ভাই আর সম্ভবত যতোদূর মনে পড়ে দিলীপদা ডিউটিতে। দিলীপদা একটা টুলে বসে রাইফেলটা বুকে আঁকড়ে ঝিমোচ্ছেন। বাম হাতে তার জ্বলন্ত হুঁকো। কমান্ডার বাইরে এসে তার হাত থেকে হুঁকোটা নিয়ে টানতে টানতে লক্ষ করেন জয়নাল ভাই নেই। দিলীপদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জয়নাল কোথায়?’ ‘পেচ্ছাব করতে গ্যাছে বোধ হয়, জানি না…’ আমরা ভেতর থেকে ওদের কথোপকথন শুনছি, কিন্তু খুব গুরুত্ব দিচ্ছেনে। জয়নাল ভাই মাঝে-মধ্যে এমন কিছু কা- করে বসেন যে আমরা তার কা-কারখানা অনেকেই মেনে নিয়েছি। কখনো কখনো তার পাগলামিটাকে প্রশ্রয়ও দিয়েছি। তার আচরণ কখনো যুদ্ধ বিরোধী নয়। হঠাৎ হারিয়ে যান, দিনভর খবর নেই। সবাই চিন্তিত। এ ওকে জিজ্ঞেস করছে, তার খবর কেউ জানে কি না। কেউই কিচ্ছু জানে না। খানিক পর অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আলোয় এসে জানান, ‘জব্বর খবর আছে। শালাদের জীবন্ত ধরতে হবে।’ কমান্ডার রেগে যান। ‘কোনো কথা না জানিয়ে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’ জানান, ‘এখন থেকে ছয় মাইল দূরে বটতলার বাজারে গিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, তার এক বন্ধু ওই বাজারে মুদির দোকানি। শালা পাক্কা মুসলিম লিগার হলেও এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কারণ পাকিস্তানিরা তার দোকান লুটপাট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। চাচাকে হত্যা করেছে। সে মুসলিম লিগ পরিচয় দিয়ে ব্যবসা করে। কিন্তু যাবতীয় ইনফরমেশন মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দ্যায়। তাদের সাহায্যও করে। ‘আমাকে আজ খাওয়ালো। আসার সময় দশটা টাকা আর পাঁচ প্যাকেট স্টার সিগ্রেট দিলো। আর বললো, পাকিস্তানিরা বাজারে আসে মাঝে-মধ্যে। সঙ্গে থাকে দশ/বারোটা রাজাকারের বাচ্চা। তারা এসেই দোকান থেকে বিনে টাকায় জিনিস নিয়ে যায়। দাম চাওয়া যায় না। চাইলই দোকানে হামলা করবে। ভাই তোরা এসে একদিন ওদের ধ্যাতানি দিলে শালারা আর এসে মানুষকে অত্যাচার করার সাহস পাবে না।’ তবুও তিনি ক্যানো কমান্ডারের অনুমতি ব্যতিরেখে বাইরে গেলেন, এটা শৃঙ্খলা ভঙ্গ। বিধায় তাকে কোয়ার্টার গার্ডে সারারাত থাকতে হবে। হাসিমুখে শাস্তি মেনে নেন তিনি। বলেন, ‘বিড়ি দিসরে ভাই। বিড়ি ছাড়া বাঁচবো না।’ কমান্ডার এক প্যাকেট সিগ্রেট আর একটা দেশলাই তার দিকে ছুঁড়ে দ্যান। ক্রিকেট বলের মতো লুফে নিয়ে বলেন, “জয় বাংলা” এতেই ঘুম হবে ইনশাল্লাহ্। একটু থেমে বলেন, আজ তো আর ডিউটি করতে হবে না, তোরাই আমাকে পাহারা দিবি। আমি দিব্বি নাক ডেকে ঘুমোবো। আরেকবার “জয় বাংলা” বলে সিগ্রেট টানতে টানতে আড়মোড়া ভেঙে শুয়ে পড়েন জয়নাল ভাই। তাকিয়ে দেখি তাঁর নাক ডাকছে।
কমান্ডারকে উদ্বিগ্ন দ্যাখায়। তিনি ভেতরে এসে সবাইকে হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দ্যান। বৈঠকের বাইরে উঠোন জুড়ে লাউ-কুমড়া-ঝিঙের মাচা। টর্স জ্বালিয়েও জয়নাল ভাইকে দেখতে পেলেন না কমান্ডার। কমান্ডার হয়তো মনে মনে ভাবেন, জয়নাল তো যুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। কারণ তাঁর বাবা-কাকাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে। সঙ্গে গ্রামের প্রায় ত্রিশ জনকে। কমান্ডার তাঁর নাম ধরে ডাকতে যাবেন, এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে “জয় বাংলা, জয় বাংলা” ধ্বনি বিষ্টিসিক্ত বাতাস দ্রুত বয়ে আনে আমাদের কাছে। আমরা খানিকটা হতচকিত হয়ে যাই। ওই মুহুর্তটুকু সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কমান্ডার নির্দেশ দ্যান, ‘শব্দ লক্ষ্য করে ত্রিভূজ পজিশনে এগোয় সব, হারি আ প, বাড়ির কাছে গিয়ে ক্রোলিং, সামনে যে আসবে সাবার করে দেবে।’ কমান্ডারের কথাগুলো সাপের গর্জনের মতো শোনায়। আমরা ক্রোলিং করে বাড়ির দুয়ারের কাছে গিয়ে দেখি, জয়নাল ভাই ওদের রাইফেলগুলোকে তাঁর পেছনে রেখে সবাইকে সারেন্ডার করিয়ে বৃষ্টির ভেতরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। ওরা হাত তুলে রয়েছে। কেউ এক পা এগোলে সমস্ত বাড়ি উড়িয়ে দেবো। মেয়েরা আসবেন না। আপনারা আমাদের মা-বোন। দূরে থাকুন।’ আমরা রাজাকারদের চারদিকে থেকে ঘিরে গোরু-ছাগলের মতো একজনের হাত অপরজনের সঙ্গে বেঁধে একটা ঘরে তুলে দরজা লাগিয়ে আগে খেতে বসলাম। রান্নাটা কিন্তু বেশ ভালো হয়েছিলো। খাসির মাংস, মাছ ভাজা, ছোলার ডাল আর দই-মিষ্টি । রীতিমতো রাজভোগ। কতোদিন এমন উপাদেয় খাদ্য পেটে যায়নি। সবাই সাধ্য মতো খেলাম।
জয়নাল ভাইয়ের একক সাহসে সে রাতে আমরা সবাই প্রাণে বেঁচে গেলাম। এখন এই দালাল-বেঈমানদের তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার। গ্রামের লোক ডাকা হলো। তারাই বলবে, যুদ্ধে এদের ভূমিকা কি? সবাই এদের একবাক্যে পাকিস্তানি দালাল-দুস্কৃতিকারী হিসেবে চিহ্নিত করলো। ওদের জন্যে গ্রামের কারো মনে শান্তি নেই। আরো বললো, এরা সমস্ত অঞ্চলে ডাকাতি করে, করে পাকিস্তানিদের দালালি। অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে, করেছে লুটপাট এবং মা-বোনের সম্মানহানি। এরা মানুষের দুষমন। শয়তান, আজরাইল। সমবেত জনগণ চিৎকার করে দাবি করলো, ‘ওদের মারো ভাই তোমরা। না পারল্যে হামাগেরে হাতেত দ্যাও, শালাগেরে জবাই করি ।‘
আমরা যা খেতে পারিনি, সেগুলো কাপড় দিয়ে বেঁধে ওদের মাথায় চাপিয়ে, কাঁধে ওদেরই কার্তুজবিহীন রাইফেল ঝুলিয়ে দিয়ে গোরু-ছাগল খেদিয়ে নেয়ার মতো করে অন্ধকারে নেমে গেলাম। রাস্তা পিচ্ছিল। বিষ্টি তখনো ঝরছে। ওই রাতে খোলা মাঠে হেঁটে চলা কী যে কষ্টসাধ্য, যে হেঁটেছে, ক্যাবল সে-ই তা জানে।
ঘাতক-দালালদের নিয়ে আমরা সবুজ ফসল ভরা মাঠ অতিক্রম করছি। অন্ধকারেও আলোকিত হয় প্রকৃতি, সেদিন আমি প্রথম অনুধাবন করি। অন্ধকারটা চোখে সয়ে গেলে চারপাশে আর আঁধার থাকে না। দ্যাখা যায় সবকিছু। আমাদের ভয় ছিলো আলপথ ব্যাঙ আর ছোট মাছ ধরে খাওয়ার লোভে ঢোরা সাপ থাকতে পারে। কামড়ে দিলে মুস্কিল হবে। বিষাক্ত সাপও শিকারের জন্যে ওঁৎ পাতে। কমান্ডার আর ডেপুটি কমান্ডারের হাতে দুটো টর্স। আর কারো কাছে নেই। তাই একজন সবার সামনে, অপর জন সবার পেছনে এগোচ্ছেন।
হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ-ছ’ মাইল অতিক্রম করে একটা জনহীন গ্রাম পেলাম। ভাঙা সব ঘরবাড়ি। সব লুটপাট করে নিয়ে গ্যাছে। বেশ বড়ো একটা দিঘি ঘিরে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো কোনো একদিন। আজ তা চেঙ্গিস-হালাকুর মতো সব ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। কোনো ঘরে টিন নেই। দু’চারটে খরের ঘর ঝড়-বিষ্টিকে উপেক্ষা করে এখনো টিকে আছে। আছে এক দঙ্গল কুকুর। আমাদের উপস্থিতি টের পেতেই ওরা ঘেউ ঘেউ করে ঘিরে ধরলো। তারপর ওদের বোধ হয় মনে হলো আমরা লুটেরা-ধর্ষক নই, নই দুর্বৃত্ত। ওরা চিৎকার বন্ধ করলো। এ ছাড়া আমাদের সঙ্গে খাবার আছে। তার গন্ধেও হয়তো চিৎকার বন্ধ করেছিলো।
বিচার শুরু হলো। প্রথমে রেকিকে দিয়ে। সে ক্যানো মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকারের বাড়িতে নিয়ে তুললো। সে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিতে পারলে তাকে দুই হাজার টাকা দেবে বলে গফুর মিয়া লোভ দেখিয়েছিলো। সেই টাকার লোভে রেকি পুরো ট্রুপসকে ওই খুনির বাড়িতে তুলেছিলো। গোফুর মিয়ার হুকুমে রাজাকারদের সে-ই খবর দিয়ে আনিয়েছে। বিধায় তার শাস্তি মৃত্যুদ-। গফুর-আমিন আর সেতাব দালালেরও একই শাস্তি। বারোজন রাজাকারের মধ্যে তিনজনকে জোর করে অর্থাৎ তাদের ভয় দেখয়েছে এই বলে যে, রাজাকার বাহিনীতে যোগ না দিলে তাদের হত্যা করা হবে। যদি বাহিনীতে যোগ দ্যায় বেতন দেয়া হবে। তারা গরীব মানুষ, জীবনের ভয়ে রাজাকারে নাম লেখাতে বাধ্য হয়। তাদের নির্দেশ দেয়া হলো, বিশ্বাসের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করলে হত্যা করা হবে না। দু’জন ভয়ঙ্কর রাজাকার ছিলো। তখনো আস্ফালন করছিলো। তাদের হাত-পা বেঁধে একটা ডোবার ধারে ফেলে রাখা হলো। ওই তিনজনকে নির্দেশ দেয়া হলো, ওদের গুলি করতে। এটাই তাদের বিশ্বাস অর্জনের প্রথম পরীক্ষা। তারা রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত। তাদের পেছনে দু’জন করে মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়ালেন। বলা তো যায় না, ওরাই ঘুরে আমাদের গুলি করতে পারে। তাই ওদের সামাল দিতে ছ’জন পেছনে রাইফেল শানিয়ে রাখলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্যরাও প্রস্তুত। অঘটন ঘটতে সময় নেবে না। ওই তিনজন বাদে অবশিষ্টদের গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত খালের ধারে-খালটি বর্ষায় নদীতে রূপান্তরিত হয়, সেখানে হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করানো হলো। কমান্ডার “ফায়ার” উচ্চারণ করতেই গুলি বর্ষিত হলো। আমি দেখতে না পেরে ঘরে ফিরে কুকুরের আগ্রাসন থেকে মজুদ খাদ্য রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত হলাম।
তিনজন রাজাকারকে আমাদের সঙ্গেই রাখা হলো। ডিউটি চলছে। দুপুরে জয়নাল ভাইয়ের বিচার। তিনি ক্যানো কমান্ডারের অনুমতি না নিয়ে একা রাজাকারদের আক্রমণ করলেন। এটাও শৃঙ্খলা ভঙ্গ। তিনি স্বীকার করলে তাঁকে অর্ধ দিবস কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি রাখা হলো। দুপুরে কেউ কিছু খেলেন না। কমান্ডার সবাইকে নিয়ে বসলেন। বললেন, ‘জয়নাল যদি অপারেশনে সাকসেস্ না হতো, তাহলো আমরা সবাই মারা যেতাম। তবে জয়নাল যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, সে জন্যে তাকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা তার সাহসিকতার বিষয়টি সেক্টর কমান্ডারকে জানাবো।
জয়নাল ভাই সূর্যাস্তের পর মুক্ত হয়েই প্রথমে বিড়ি চাইলেন। হাসলেন। সারাদিন বিড়ি খাইনি, দে, দু’টো একসঙ্গে দে, আগে টানি, তারপর খাওয়া যাবে। খাবারগুলো খর-কুটো দিয়ে গরম করতে করতে রাত আটটা বেজে গ্যালো। একসঙ্গে খেয়ে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন ভোরে বিষ্টি নেই। কিন্তু বাতাসে শীতের আমেজ। শরৎ তখন যাই যাই করছে। হেমন্তের আগমন বার্তা ছড়াচ্ছে সূর্যের আলো, বৃক্ষরাজি আর ধূসর আকাশ। মৃত্যুর ফাঁদ থেকে রক্ষা পেয়ে আমরা বেঁচে আছি, এটা যখনই ভাবছি, ততোই আতঙ্কিত ও বিস্মিত হচ্ছি। জয়নাল ভাই বিড়ি টানতে টানতে বললেন, ‘রাখে আল্লাহ্ মারে কে’…বলো “জয় বাংলা।”